একটি বনভোজনের অভিজ্ঞতা/ একটি ছুটির দিনের অভিজ্ঞতা |
[রচনা-সংকেত: ভূমিকা বনভোজনের উদ্দেশ্য প্রস্তুতি স্থান আয়োজন – আনন্দ উপভোগ – ভোজনপর্ব – উপসংহার]
‘ভোর থেকে আজ বাদল ছুটেছে, আয় গো আয়-
কাঁচা রোদখানি পড়েছে বনের ভিজে পাতায়।’
ভূমিকা
শ্রাবণের ঘনঘোর বর্ষার ফাঁকে রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত এমন একটা দিনে যদি রবিবার কিংবা অন্য কোনো ছুটির বার পড়ে, তাহলে পাড়ার বন্ধুরা মিলে কিছু একটা করার ইচ্ছে যে মনের মধ্যে জেগে উঠবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী। ইচ্ছেটা প্রথম জাগে অবশ্য সন্দীপনের মাথায়। সে-ই প্রথম ফোন করে জানিয়েছিল কাছাকাছি থাকা বন্ধুদের। প্রথম প্রস্তাবেই সবাই রাজি। বনভোজন বলে কথা। গতকাল হয়ে গেল সেই বনভোজন।
ছুটির দিনে বনভোজনটির উদ্দেশ্য
মানবজীবন এমনই যে, খাওয়ার সংস্থানই জীবনের সবটা নয়। সেকারণে বলা হয় – ‘Man cannot live by bread alone’। আসলে খাদ্যের পাশাপাশি মানুষ চায় তার প্রবাহমান জীবনে একটু আনন্দ বা খুশি। তার জন্যই সে খেলে, উৎসব করে, ঘোরে কিংবা মজা করে। ছুটির দিনে আমাদের আয়োজিত বনভোজনটির পিছনে উদ্দেশ্য ছিল সেরকমই একটু আনন্দ বা খুশি, সবাই মিলে একটু যেন বা মজা করার ইচ্ছেও। তা ছাড়া বর্ষা থেমে রোদ ওঠায় বুকের ভিতরে যেন বেজে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের সেই চিরন্তনের ছুটির গান-
‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি
আহা, হাহা, হা…’
ছুটির দিনে এমনটা তো হতেই পারে, তাই না? ছুটিটাকে বিশেষভাবে কাটানোর জন্যই আমরা আয়োজন করেছিলাম ওই বনভোজন বা চড়ুইভাতির।
বনভোজনের প্রস্তুতি
কোনোরকম পূর্বপরিকল্পনা না থাকায় আমাদের বনভোজনটির প্রস্তুতি ছিল খানিকটা তাৎক্ষণিক। সকালে ফোনে ফোনে প্রস্তাবনা। মোট যোলোজনের সম্মতিদান। ব্যস, আমরা সবাই তৈরি দুপুরবেলায় বনভোজনে মাতার জন্য।
বনভোজনটির স্থান
আমাদের গ্রামের মধ্যেই রয়েছে ভারি সুন্দর একটা জায়গা কাঠিয়াবাবার মন্দির। গাছে গাছে, ফুলে ফুলে, ছোটো ছোটো আরও অনেক মন্দিরে সজ্জিত সেই স্থানটির পাশে রয়েছে অনেকগুলো পুকুর আর বিস্তীর্ণ একটা ঝিল। সেই ঝিলের একটা পাড়ই বনভোজনের জন্য বেছে নিয়েছিলাম আমরা।
আয়োজন
পূর্বপরিকল্পনা ছিল না বলে চাঁদা তুলে খুব বেশি আয়োজন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। খিচুড়ি আর ইলিশমাছ ভাজা- এই ছিল আমাদের খাদ্যতালিকা। রান্নার ক্ষেত্রেও তাই আলাদা করে রাঁধুনি জোগাড়ের দরকার হয়নি। আমাদের চেয়ে বছর চারেকের বড়ো সুদীপদা নিজেই দায়িত্ব নিয়েছিল। অতএব সকালে সেনডাঙা বাজার থেকে জিনিসপত্র জোগাড় করে একটা ভ্যানে তা চাপিয়ে নিয়ে সাইকেলেই পৌঁছে গেছিলাম ঝিলের পাড়ে।
আনন্দ উপভোগ
বনভোজনের দিন রান্না যেখানে হবে, সেখানে পৌঁছে সবাই মিলে সুদীপদাকে সবকিছু গুছিয়েগাছিয়ে দিয়ে আমরা সবাই লেগে পড়লাম মন ভরানোর কাজে। খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরলাম-ফিরলাম। গেলাম কাঠিয়াবাবার মন্দির চত্বরের পার্কে, সেখান থেকে মন্দির লাগোয়া সাতখানা পুকুরের এ-পাড় থেকে ও-পাড় ছোটাছুটি করেই কাটল কিছুটা সময়। টিফিনে ডিম-কলা-পাউরুটি খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। আবার বেরোলাম জঙ্গলের খোঁজে। সরকারি উদ্যোগে ঝিলের পশ্চিমপাড়ে সার দিয়ে অসংখ্য গাছ লাগানো হয়েছিল বেশ কিছু বছর আগে। সেই গাছগুলোই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে জনমনোহরণী। মিঠে বাতাসের মমতার স্পর্শ সারা গায়ে মেখে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে মনে হতে লাগল যেন-
‘কত দিন পরে আজিকে ফিরিল ধরণীর বরণীয়-
দক্ষিণ-বায়ে উড়িয়াছে তার পরাগ-উত্তরীয় !
(-মোহিতলাল মজুমদার)
তারই ফাঁকে কোথাও দেখলাম জলের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে মাছের সারি। কোথাও বকেরা চরে বেড়াচ্ছে মাছের খোঁজে। কোথাও বা মাছরাঙাপাখি গাছের ডালে বসে থেকে থেকে হঠাৎ করে জলে ঝাঁপ দিয়ে মাঝ ধরে পালাচ্ছে। সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
ভোজনপর্ব
দুপুর দুটোর দিকে খেতে বসলাম সবাই মিলে। সুদীপদা যে খিচুড়ি এতটা ভালো রাঁধতে পারে, কে জানত। গরম গরম খিচুড়ি আর গরম গরম ইলিশ মাছ ভাজা আহ, খেতে খেতে প্রাণটা জুড়িয়ে যেতে লাগল। আমরা জানতাম বাপন একটু বেশিই খায়। এবারেও খাচ্ছিল। তা নিয়ে আমরা মজা করে আবৃত্তি করতে ছাড়িনি-
‘অল্পেতে খুশি হবে দামোদর শেঠ কি
মুড়কির মোয়া চায়, চায় ‘ভাজা ভেটকি’
(-সুকুমার রায়)
উপসংহার
খাওয়াদাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ চলল গল্পগুজব। কয়েকজন দাবার বোর্ড এনেছিল। সেই খেলা চলল। অয়নাংশুর গান শুনলাম। অন্ত্যাক্ষরীও চলল একটা সময়। অবশেষে সন্ধের মুখে একরাশ ভালোলাগার অনুভূতি নিয়ে ফিরে এলাম বাড়িতে। ছুটির দিনটা ভালোই কাটল।