একটি গ্রামের আত্মকথা রচনা 500+ শব্দে

একটি গ্রামের আত্মকথা রচনা

একটি গ্রামের আত্মকথা রচনা
একটি গ্রামের আত্মকথা রচনা

ভূমিকা

সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা বাংলা আমার মা। তার স্নেহই আমার বুকভরা একরাশ মাটি আর আমি হলাম সেই মাটিরই অফুরন্ত ভালোবাসামাখা ছোট্ট একটা গ্রাম। অখ্যাত এবং অপূর্ণ যদিও, তবু তো এই বাংলারই একজন। হে পাঠকবর্গ, একটু তাকাও এদিকে-

‘ঐ যে গাঁটি যাচ্ছে দেখা ‘আইরি’ খেতের আড়ে
প্রান্তটি যার আঁধার-করা সবুজ কেয়াঝাড়ে,
পুবের দিকে আম-কাঁঠালের বাগান দিয়ে ঘেরা’,
(-যতীন্দ্রমোহন বাগচী)

ওটাই আমি গো। এতই অখ্যাত যে, আমার নামটা এক-দু’বার শোনার পর অনেকেই আর মনে রাখে না। তবু যদি তোমরা শুনতে চাও তো বলি, আমার নাম সেনডাঙা।

জন্মের কথা

জন্মেছিলাম অনেক বছর আগে। আজ আর সাল-তারিখ ঠিকঠাক মনে নেই, তবে মনে আছে এটুকু যে, তখন চলছিল জমিদারি আমল এবং এখন আমার অবস্থান যেখানে, সেখানে প্রথমবার ঘর বেঁধে বসবাস শুরু করেছিল ‘সেন’ উপাধিধারী কিছু পরিবার। তাদের ‘সেন’ উপাধি থেকেই আমার নাম হয়ে যায় ‘সেনডাঙা’। জন্মটা যেভাবেই হোক, এতদিন বাদে আমি বুঝতে পেরেছি-

‘সার্থক জনম আমার
জন্মেছি এই দেশে’
(-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

আমার অবস্থান

আমার অবস্থান উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায়। থানা অশোকনগর। আমার উত্তরে রয়েছে কেওটসা-ভাণ্ডারগাছা গ্রাম, পশ্চিমে পুমলিয়া, দক্ষিণে বামুনডাঙা এবং পূর্বে চাপড়া গ্রাম। বর্তমানে আমি ভুরকুণ্ডা গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত।

অতীতের রূপ

অতীতে, আমার জন্মের প্রথমপর্বে আমি ছিলাম কেবলই বনজঙ্গলে ভরা আর চাষের জমি-সমৃদ্ধ একটা গ্রাম। আশেপাশে ছিল বাঁশঝাড়, অসংখ্য খানাখন্দ, ডোবা। সেনেরা তাদের সুবিধার জন্য কিছু পুকুরও কাটিয়েছিল। পায়ে চলার মতো রাস্তাঘাটও খুব বেশি একটা ছিল না তখন। সাপের দৌরাত্ম্য তো ছিলই, ছিল গোসাপ, ভাম আর শিয়ালদের আড্ডা। রাতের বেলায় শিয়াল ডাকত হুক্কা-হুয়া-হুয়া-। তা সত্ত্বেও দিনের-পর-দিন বেড়েছি আমি।

বর্তমানের রূপ

বর্তমানে অবশ্য আমি অনেকটাই বদলে গিয়েছি। বসবাসের লোকজন তো বেড়েছেই। আগেকার কুঁড়েঘরের জায়গায় তৈরি হয়েছে অনেক পাকাবাড়ি। রাস্তাঘাটে অনেক জায়গায় ইট পড়েছে। আমার বুক চিরে তৈরি হয়েছে বড়ো একটা পিচের রাস্তা। সে রাস্তায় এখন গাড়িঘোড়াও চলে কিছু কিছু। বিদ্যালয়, গ্রন্থাগার, বাজার, ডাক্তারখানা, ব্যাংক- সবই এখন এখানে গড়ে উঠেছে, যা আগে ছিল না। এখানকার মানুষদের কেউ কেউ এখন চাষের পাশাপাশি চাকরি করে কিংবা ব্যাবসা করে। তবুও এখনও-

‘এখানে আকাশ নীল— নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল
ফুটে থাকে হিম শাদা— রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;”
(-জীবনানন্দ দাশ)

তোমার কেউ যদি কোনোদিন আমাকে দেখতে আসো, হাঁটো আমার এদিকে-ওদিকে, তাহলে হয়তো দেখতে পাবে- কোথাও ‘বাঁশবাগানের পাশটি দিয়ে পাড়ার পথটি বাঁকা’; কোথাও বা বিলের জলে ফুটে আছে পদ্ম কিংবা শালুকফুল। মোটকথা সৌন্দর্যের এক অপরূপ মূর্তিই দেখতে পাবে চারদিকে। আমার মতো গ্রামগুলোকে নিয়েই তো কবি লিখেছিলেন-

‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লিজননী, 
ফুলে ও ফসলে কাদা-মাটি-জলে ঝলমল করে লাবণি।’
(-কাজী নজরুল ইসলাম)

তাই কি শুধু? এখানকার মানুষের মধ্যে আজও রয়েছে সরলতা, আন্তরিকতা ও আতিথেয়তার গুণ। রয়েছে সম্প্রীতিবোধও।

দুঃখসুখ

তা বলে কি আমার বুকে দুঃখ নেই? দুঃখের কোনো স্মৃতি নেই আমার? নিশ্চয় আছে। চিকিৎসার অভাবে কত মানুষকে যে মরতে দেখেছি আমি। অজন্মা আর দুর্ভিক্ষের দিনে না খেয়েও মরতে দেখেছি। দেখেছি জমিদার কিংবা ইংরেজদের অত্যাচারও। তবুও তার মধ্যেই যখন গ্রামবাসীরা মিলেমিশে থেকেছে, নানান পালাপার্বণে মেতেছে উৎসবে-আনন্দে, এখনও যখন মাতে, তখন মনে হয়-আমার মতো সুখী কে?

শেষকথা

মধু কবি একবার লিখেছিলেন- ‘জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে?’-এই চিরন্তন রীতি মেনে আমাকেও চলে যেতে হবে একদিন। তবু যতদিন বেঁচে থাকব, মনেপ্রাণে চাইব, শহর যেন বাড়তে বাড়তে এসে আমাকে কোনোভাবেই গ্রাস করে না নেয়। আমি তো শুধুই সহজসরল, খুব সাধারণ একটা গ্রামমাত্র। আমার সেই গ্রাম হয়ে থাকাটাই বেশি শোভনীয় নয় কি?

আরও পড়ুন1943 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় দুর্ভিক্ষের কারণ গুলি কী ছিল

Leave a Comment