একজন বাঙালি বিজ্ঞানী রচনা 400 শব্দে

একজন বাঙালি বিজ্ঞানী রচনা

একজন বাঙালি বিজ্ঞানী রচনা
একজন বাঙালি বিজ্ঞানী রচনা
“প্রাণের আগ্রহবার্তা নির্বাকের অন্তঃপুর হতে
অন্ধকার পার করি আনি দিলে দৃষ্টির আলোতে।”
-রবীন্দ্রনাথ

ভূমিকা

বিজ্ঞানে মৌলিক অবদান রেখে যে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা বিশ্বের দরবারে ভারতকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু তাঁদের অন্যতম। তাঁর মহোত্তম কীর্তি উদ্ভিদের প্রাণসত্তার তত্ত্ব আবিষ্কার। তিনি কেবলমাত্র বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিশ্বকে দেখেননি, দেখেছেন দার্শনিকের সামগ্রিক দৃষ্টিতে। তাই তাঁর জীবন ও বাণী আমাদের এক পরিপূর্ণ জীবনের সন্ধান দেয়।

জন্ম ও বংশপরিচয়

১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের বিক্রমপুর জেলার রাঢ়িখাল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন জগদীশচন্দ্র বসু। পিতা ভগবানচন্দ্র বসু ছিলেন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মাতা উদারপ্রাণা বামাসুন্দরী দেবী। পিতার কাছ থেকে স্বদেশপ্রেম ও শিল্পানুরাগ এবং মায়ের কাছ থেকে সরলতা ও উদারতার শিক্ষা পেয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র।

শিক্ষা ও কর্মজীবন

ফরিদপুরের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষালাভের পর জগদীশচন্দ্র ভরতি হন কলকাতার হেয়ার স্কুলে। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভরতি হন। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিএ পাস করেন। এরপর জগদীশচন্দ্র লন্ডনে গিয়ে ডাক্তারি পড়তে শুরু করেন। কিন্তু শারীরিক কারণে ডাক্তারি পড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে জগদীশচন্দ্র প্রকৃতিবিজ্ঞানে ট্রাইপোস হন। ওই একই বছরে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন। স্বদেশে ফিরে জগদীশচন্দ্র অধ্যাপনাকেই জীবনের ব্রতরূপে গ্রহণ করেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকের পদে যোগ দেন।

গবেষণা ও নতুন নতুন তথ্যের আবিষ্কার

পরাধীন দেশের বৈষম্য, অপমান ও গ্লানির মধ্য দিয়েই জগদীশচন্দ্রকে অগ্রসর হতে হয়েছিল বিজ্ঞানসাধনার বন্ধুর পথে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার তিনি ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ। ইতালীয় বৈজ্ঞানিক মার্কোনি ওয়‍্যারলেস টেলিগ্রাফির কৃতিত্ব অর্জন করেন। কিন্তু এ ব্যাপারে জগদীশচন্দ্র কলকাতায় অনেক আগেই কৃতিত্বের সাক্ষ্য রেখেছিলেন।

কেবল পদার্থবিজ্ঞানেই নয়, জীববিজ্ঞানেও তিনি অসামান্য অবদান রেখে গিয়েছেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, প্রাণী ও জড়ের প্রকৃতির মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত ঐক্য আছে। তাঁর উদ্ভাবিত যন্ত্রাদির সাহায্যে তিনি দেখান যে, বাহ্যিক উত্তেজনায় প্রাণী যেমন সাড়া দেয়, গাছপালাও তেমনই সাড়া দেয়। মানুষেরই মতো গাছপালাও উত্তাপ, শৈত্য, আলো, কোলাহল ও অন্যান্য উদ্দীপক ব্যাপারে একইরকমভাবে প্রতিক্রিয়া ঘটায়, যা পরিণামস্বরূপ গাছপালার মধ্যে প্রাণের অস্তিত্বের তত্ত্বটিকেই আবিষ্কার ও প্রতিষ্ঠিত করে।

উপযুক্ত পরীক্ষাগার ও অর্থবলের অভাব সত্ত্বেও তিনি নানাবিধ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেন। তাঁর উদ্ভাবিত ক্রেস্কোগ্রাফ, রেজোন্যান্ট রেকর্ডার, ফাইটোগ্রাফ ও অপটিক্যাল স্ফিগমোগ্রাফ কেবল ভারতে নয়, পশ্চিমি দুনিয়াতেও তাঁকে সম্মানের আসনে বসায়। আধুনিক ‘জীব-পদার্থবিজ্ঞান’ বা ‘বায়ো-ফিজিক্স’ নামক বিজ্ঞানের শাখার তিনিই জনক।

পুরস্কার ও সম্মান

জগদীশচন্দ্রের অসাধারণ কীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘নাইটহুড’ উপাধিতে ভূষিত করে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে। তিনি আরও অনেক পুরস্কার পান যেমন ‘ফেলো অফ দ্য রয়‍্যাল সোসাইটি,’ ‘কমপ্যানিওন অফ দ্য অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার’ প্রভৃতি। ভারতের মনীষীরাও এই যুগোত্তীর্ণ প্রতিভাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে দ্বিধা করেননি। স্বামী বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধি, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ মনীষীরাও এই মহান বৈজ্ঞানিকের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন।

উপসংহার

জগদীশচন্দ্র একাধারে ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী। প্রধানত বিজ্ঞানী হলেও তাঁর মধ্যে একটি দুর্লভ শিল্পচেতনা ছিল। তার পরিচয় পাওয়া যায় জগদীশচন্দ্রের সীমিত সাহিত্যকর্মের মধ্যে। মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম পথপ্রদর্শক ছিলেন তিনি। তিনি মনে করতেন বিজ্ঞানই পারে মানুষের দুর্দশা লাঘব করতে। তাঁর মতে, “দেশের আর্থিক উন্নতিসাধন করিতে হইলে কৃষি এবং শিল্প উভয়েরই উন্নতিসাধন করা আবশ্যক। ইহা করিতে হইলে বিজ্ঞানের উপর নির্ভর করিতেই হইবে।” ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নভেম্বর আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু গিরিডি শহরে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

Leave a Comment