উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজগুলির কীরূপ ভূমিকা ছিল

উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজগুলির কীরূপ ভূমিকা ছিল
উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজগুলির কীরূপ ভূমিকা ছিল?

ভূমিকা

উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিল ব্রাহ্মসমাজ। রাজা রামমোহন রায় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে যে ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন, পরবর্তীকালে সেটি ব্রাত্মসমাজ নামে খ্যাতি লাভ করে।

ব্রাহ্মসমাজের বিভিন্ন শাখা

রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজ পরবর্তীকালে বিবর্তিত ও বিভাজিত হয়। যেমন-

[1] দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে আদি ব্রাহ্মসমাজ।

[2] কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ভারতবর্ষীয় ব্রাত্মসমাজ ও নববিধান ব্রাহ্মসমাজ।

[3] শিবনাথ শাস্ত্রী ও আনন্দমোহন বসুর নেতৃত্বে গঠিত হয় সাধারন ব্রাহ্মসমাজ।

সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজগুলির ভূমিকা

ব্রাহ্মসমাজের সংস্কার আন্দোলন : ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামমোহন রায় সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। তাঁর আন্দোলনের ফলে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ১৭ নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন: স্বামীর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী যাতে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে পারে, তারজন্য স্বামীর সম্পত্তির উপর স্ত্রীর অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগঠিত করে রামমোহন রায় পরিচালিত ব্রাহ্মসমাজ।

বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন: রাজা রামমোহন রায় পুরুষের বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন।

কৌলীন্য প্রথা ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন :
ব্রাহ্মসমাজ হিন্দুসমাজে প্রচলিত কৌলীন্য প্রথা ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেছিল।

জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন: সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথার ভ্রান্ত ধারণা দূর করার জন্য আন্দোলন করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আদি ব্রাত্মসমাজের সংস্কার আন্দোলন: রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশ করে ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ প্রচার করেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের ঘোর বিরোধী এবং অপর দিকে বিধবাবিবাহ প্রচলনের সমর্থক ছিলেন।

কেশবচন্দ্র সেন পরিচালিত ব্রাত্মসমাজগুলির সংস্কার আন্দোলন: কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজের সংস্কার আন্দোলন আরও গতিশীল হয়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেন ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে তিনি গড়ে তোলেন নববিধান ব্রাহ্মসমাজ।

কেশবচন্দ্র সেন সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও পর্দাপ্রথার বিরোধিতা করেন। এর পাশাপাশি তিনি সমাজে বিধবাবিবাহ, অসবর্ণ বিবাহের প্রচলন, শিক্ষার প্রসারের পক্ষে আন্দোলন করেন।

তিন আইন: কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের ফলেই সরকার তিন আইন (১৮৭২ খ্রি.) পাস করে। এর ফলে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ ও অসবর্ণ বিবাহ আইনসিদ্ধ হয়।

উপসংহার

কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে মনোমালিন্যের জন্য শিবনাথ শাস্ত্রী ও আনন্দমোহন বসু ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ ব্রাত্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করে সমাজসংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেন। কিন্তু ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজ ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজগুলি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছে।

Leave a Comment