ইউরোপে মেটারনিখ ব্যবস্থার প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো

ইউরোপে মেটারনিখ ব্যবস্থার প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো
ইউরোপে মেটারনিখ ব্যবস্থার প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো।

ইউরোপে মেটারনিখ ব্যবস্থার প্রভাব

ইউরোপের ইতিহাসে ১৮১৫-১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল মেটারনিখের যুগ নামে পরিচিত। ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার আদর্শের চরম বিরোধী মেটারনিখ সমস্ত রকমের উদারনৈতিক সংস্কারমূলক চিন্তাধারাকে অবদমিত করার মনোভাব নিয়ে অস্ট্রিয়া এবং ইউরোপের সর্বত্র মেটারনিখতন্ত্রকে কায়েম করতে উদ্যত হন।

অস্ট্রিয়ায় মেটারনিখ পদ্ধতির প্রয়োগ

বিভিন্ন ভাষা, জাতিগোষ্ঠীর মানুষ সংবলিত দেশ অস্ট্রিয়ার ঐক্য বজায় রাখার জন্য উদারনৈতিক গণতন্ত্র অপেক্ষা প্রতিক্রিয়াশীল পুরাতনতন্ত্রই বেশি কার্যকর। তাই অস্ট্রিয়ায় যাতে ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত ভাবধারা না প্রবেশ করতে পারে সেই জন্য উদারপন্থী ছাত্র ও অধ্যাপকদের কারারুদ্ধ করানোর ব্যবস্থা হয়; অস্ট্রিয়ায় ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো বিষয় পড়ানো ব আলোচনা নিষিদ্ধ হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে ক্যাথলিক গির্জার প্রাধান্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়।

প্রতিক্রিয়া

মেটারনিখতন্ত্রের অভিযাতে ফ্রান্সে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় ফেব্রুয়ারি বিপ্লব। সমগ্র ফ্রান্সের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপে এর প্রভাব পড়ে। অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের অধীন হাঙ্গেরিতে জাতীয়তাবাদী নেতা লুই কসুথের নেতৃত্বে ব্যাপক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দরুন হাঙ্গেরি স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। একইভাবে বোহেমিয়াতেও চেক জাতি আন্দোলনে সাফল্য লাভ করে। শেষ পর্যন্ত ১৮৪৮-এর ১৩ মার্চ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে সর্বসাধারণের তীব্র গণ আন্দোলনের দরুন মেটারনিখ পদত্যাগ করে ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান। ফলে মেটারনিখতন্ত্রের পতন ঘটে।

ফ্রান্সে মেটারনিখতন্ত্রের প্রভাব

ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত ন্যায্য অধিকার নীতি অনুসারে ফ্রান্সে বুরবো রাজবংশের শাসন ফিরে আসে। পুরাতন্ত্রে বিশ্বাসী দশম চার্লসের আমলে মন্ত্রী পলিগন্যাক এমন কিছু সংস্কারবিমুখ বিপ্লবী ভাবাদর্শবিরোধী সিদ্ধান্ত কার্যকর করার চেষ্টা করেন যে, তার পরিণতিতে সমগ্র ফ্রান্স ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে এই প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। স্বৈরাচারী রাজবংশ বিদায় নিয়ে অর্লিয়েন্স বংশের রাজা লুই ফিলিপ সিংহাসনে বসেন। লুই ফিলিপ এক মধ্যপন্থা মেনে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও তার এই মধ্যপন্থী নীতি ফ্রান্সবাসীদের মধ্যে অসন্তোষের বাতাবরণ সৃষ্টি করে। ফলত ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় সশস্ত্র বিপ্লব। ফ্রান্সে রাজতান্ত্রিক ভাবধারার অবসান ঘটে। এর অভিঘাত ছড়িয়ে পড়ে অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ইটালি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে যা মেটারনিখতন্ত্রের পতনকে সুনিশ্চিত করে।

ইটালিতে মেটারনিখতন্ত্রের প্রভাব

ইটালিতে একদিকে ছিল অস্ট্রিয়া-সহ অন্যান্য বিদেশি রাষ্ট্রের প্রভুত্ব, অন্যদিকে মেটারনিখের উদ্দেশ্য ছিল এখানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন করে পুরাতনতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখা। কিন্তু তার এই অভিসন্ধিকে ব্যর্থ করার উদ্দেশ্যে কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ঐক্য আন্দোলন-রিসঅর্গিমেন্টো বা পুনর্জাগরণের প্রয়াস। বিদেশি শাসন ও দমননীতির প্রতিবাদে শুরু হয় কার্বোনারি আন্দোলন। জোসেফ ম্যাৎসিনির নেতৃত্বে ইয়ং ইটালি বা নব্য ইটালি দল ইটালিকে জাতীয়তাবাদের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করায়। শেষকালে সার্ভিনিয়া-পিডমন্টের প্রধানমন্ত্রী ক্যাজুর ও ম্যাৎসিনিপন্থী গ্যারিবল্ডির নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলন, বিদেশি প্রভুত্বকারী শক্তির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের দ্বারা ইটালি স্বাধীন হয়। মেটারনিখ ব্যবস্থাপ্রসূত পুরাতনতন্ত্রের আবরণ সরিয়ে ইটালি ভৌগোলিক সংজ্ঞা থেকে একটি ঐক্যবন্ধ রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে।

জার্মানিতে মেটারলিখতন্ত্রের প্রভাব

ভিয়েনা সম্মেলনের (১৮১৫ খ্রি.) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিখকে জার্মানির রাষ্ট্র সমবায়ের সভাপতি নিয়োগ করা হয়। তিনি পুরাতনতন্ত্রকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে কার্লসবাড ডিক্রি জারি করে ছাত্র সংগঠন। ও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ ইত্যাদি দমনমূলক রক্ষণশীল নীতি প্রয়োগ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র, অধ্যাপক, পাঠ্যক্রম সবকিছুর উপরই সরকারি নজরদারি চালানোর ব্যবস্থা করা হয়। এইভাবে মেটারনিখ ব্যবস্থা বলবৎ করার মাধ্যমে জার্মানির ঐক্যের পথে অন্তরায় সৃষ্টির সবরকম চেষ্টা হলেও ঐক্যের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন সকল বাধা দূর করে দেয়। জার্মানির বিভিন্ন ছাত্র, অধ্যাপক, কবি, দার্শনিক দ্বারা প্রচারিত অখণ্ড জার্মান জাতি গঠনের জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বা সর্বজার্মানবাদ এই ঐক্যের ভিত্তি স্থাপন করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় জোলভেরাইন নামক শুল্কসংঘের দ্বারা অর্থনৈতিক ঐক্যকরণের প্রয়াস। এরপর প্রথমে জুলাই বিপ্লব ও পরে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের অভিঘাতে জার্মানিতে শুরু হয় ঐক্য আন্দোলন। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির বিভিন্ন রাজ্য থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ফ্রাঙ্কফোর্ট পার্লামেন্ট জার্মানিকে ঐক্যের পথে বেশ কিছুটা অগ্রসর করে। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে বিসমার্ক প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর ‘রক্ত ও লৌহ নীতি’ দ্বারা জার্মানির ঐক্যকরণ সম্পন্ন করেন। জার্মানির উপর অস্ট্রিয়ার প্রভার বিলুপ্ত হয়।

মূল্যায়ন

মেটারনিখের এই ধরনের তীব্র দমনমূলক রক্ষণশীল নীতি গ্রহণের পিছনে ছিল উদারতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি আধুনিক ভাবধারার ধ্বংসসাধনের প্রচেষ্টা। এই ধরনের মনোভাবের জন্য মেটারনিখ নানাভাবে সমালোচিত হলেও কয়েকটি ইতিবাচক বিষয় অস্বীকার করা যাবে না। এই নীতিই ইউরোপকে ৪০ বছরের জন্য রাজনৈতিক অস্থিরতা ও যুদ্ধের অশান্তি থেকে মুক্তি দিয়েছিল। ফলস্বরূপ সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে এই শান্তি ও স্থিতিশীলতার কারণে। মেটারনিখের নিজের দেশ অস্ট্রিয়ার মতো বহু জাতি, ভাষা, গোষ্ঠীভুক্ত একটি জাতিকে ঐক্যের বাঁধনে বেঁধে রাখার ক্ষেত্রে মেটারনিখের নীতি যুক্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু এই ব্যবস্থার সবথেকে বড়ো সমস্যা ছিল এর নেতিবাচকতা ও সংস্কার বিরোধিতা। ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত আধুনিক ভাবধারার গতিরোধ করার চেষ্টা করে মেটারনিখ যেভাবে যুগধর্মকে অস্বীকার করেন তার পরিণতিতেই এই ব্যবস্থার ব্যর্থতা নিহিত ছিল। তাই ইউরোপের বিভিন্ন দেশ মেটারনিখের নীতিকে ত্যাগ করে। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড, ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া ও ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স এই নীতি বর্জন করে। এরপর আসে ১৮৪৮-এ ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের আঘাত। তীব্র ছাত্র ও শ্রমিক আন্দোলনে জর্জরিত হয়ে মেটারনিখের প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করা ও ইংল্যান্ডে পালিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপে মেটারনিখ যুগের অবসান ঘটে।

Leave a Comment