ভূমিকা
অনুপম ভাষার জাদুতে স্বপ্ন বিলিয়েই ঋদ্ধ হন স্বপ্নের কোনো কোনো জাদুকর। তাঁদের কেউ কেউ কবি, কেউ নাট্যকার-প্রবন্ধকার, কেউ বা কথাসাহিত্যিক। ভাষার সেইসব জাদুকররা নিজেদের সার্থক রচনার দ্বারা এবং আপন প্রতিভার বলেই জয় করে নেন কিছু পাঠকের হৃদয়। যেমন নিজের অনুপম রচনাগুলো দিয়ে আমার মনকে জয় করে নিয়েছেন কথাকার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই আমার প্রিয় লেখক।
লেখকের জন্ম-পরিচয়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম হয় ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর নদিয়া জেলার কাঁচরাপাড়ার নিকটবর্তী ঘোষপুর অবস্থিত মুরাতিপুর গ্রামে মামার বাড়িতে। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল বনগাঁ মহকুমার বারাকপুরে। পিতার নাম ছিল মহানন্দ এবং মায়ের নাম ছিল মৃণালিনী দেবী।
শিক্ষাজীবন
গ্রামের পাঠশালায় পড়াশুনা শেষ করে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে বনগাঁর ‘বনগ্রাম উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়’-এ ভর্তি হন বিভূতিভূষণ। সেখান থেকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাশ করেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন রিপন কলেজ (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে প্রথম শ্রেণিতে আই. এ. এবং ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ডিস্টিংশনবাহ বি. এ. পাশ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. ক্লাসে ভর্তি হলেও অর্থাভাবে পরীক্ষা দেওয়া হয়ে ওঠেনি তাঁর।
কর্মজীবন
বিভূতিভূষণের কর্মজীবন ছিল বিচিত্র। কখনও তিনি শিক্ষকতা করেন জাঙ্গিপাড়া স্কুলে (১৯১৯-২০) এবং হরিনাভি ইংরেজি বিদ্যালয়ে (১৯২০-২২), কখনও হয়েছেন ‘গো রক্ষিনী সভা’র প্রচারক (১৯২২), কখনও ‘পাথুরিয়াঘাটা জমিদারি এস্টেটের’ একান্ত সচিব ও সহকারি ম্যানেজার (১৯২৩)। ১৯২৪-১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত খেলাত ঘোষ মেমোরিয়াল স্কুল এবং পরে বারাকপুরের নিকটবর্তী গোপালনগরের ‘হরিপদ ইনস্টিটিউশনের শিক্ষক হন।
রচিত সাহিত্য
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বড়োদের ও ছোটোদের মিলিয়ে বহু উপন্যাস, গল্প ও দিনলিপি রচনা করেছেন। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ‘উপেক্ষিতা’ (১৯২২) গল্পটি প্রকাশের ভিতর দিয়ে বাংলা সাহিত্যে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। প্রথম উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯) তাঁকে খ্যাতি এনে দেয়। পরে তিনি লেখেন ‘অপরাজিত’, ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’, ‘আরণ্যক’, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ‘ইছামতী’ প্রভৃতি উপন্যাস এবং ‘মেঘমল্লার’, ‘মৌরিফুল’ প্রভৃতি ছোটোগল্প সংকলন। ছোটোদের জন্যে লেখেন ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘হীরামানিক জ্বলে’ প্রভৃতি উপন্যাস ও ‘তালনবমী’র মতো ছোটোগল্প। ‘তৃণাঙ্কুর’, ‘অভিযাত্রিক’, ‘ঊর্মিমুখর’ তাঁর বিখ্যাত দিনলিপিমূলক রচনা।
কেন প্রিয় লেখক
বিভূতিভূষণকে লেখক হিসেবে আমার ভালো লাগার পিছনে বেশ কিছু কারণ আছে। সেই বিশেষ কারণগুলো হল-
(ক) প্রকৃতির মায়াময় রূপচিত্রণ: ‘পথের পাঁচালী’, ‘আরণ্যক’ প্রভৃতি উপন্যাস এবং ‘তৃণাঙ্কুর’, ‘বনে পাহাড়ে’, ‘হে অরণ্য কথা কও’ প্রভৃতি দিনলিপি ধরনের গ্রন্থে প্রকৃতির অপরূপ মায়াময় চিত্র তথা ‘colour and form’-এর জগৎ অঙ্কন করেছেন বিভূতিভূষণ। তা কখনও বাংলার গ্রামের, কখনও বনজঙ্গল-শৈলমালায় ঘেরা মনভোলানো প্রকৃতির suffocat- ing sensuousness-এর স্বপ্নরাজ্যের। প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ এইসব গ্রন্থে অন্য মাত্রা পেয়েছে। এমনটা আর কোনো গ্রন্থে তেমন একটা পাওয়া যায় না।
(খ) অপার্থিব স্বপ্নময় জগতের চিত্রাঙ্কন: The poetry of the earth is never dead’ কবি কাট্স-এর এই বক্তব্য ছুঁয়েই যেন বিভূতিভূষণের কোনো কোনো লেখায় পৃথিবী হয়ে উঠেছে সুরলোকবিহারের পৃথিবী। বিশেষত ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে তিনি অরণ্যপ্রকৃতির আড়ালে এক ঐশী ও অপার্থিব দেবলোকের সান্নিধ্যও অনুভব করেছেন। সেখানে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর অতীন্দ্রিয় ভাবুকতা।
(গ) গ্রাম্যজীবনের বাস্তব চিত্রাঙ্কন: ‘পথের পাঁচালী’ তো বটেই, ‘ইছামতী’, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ‘বিপিনের সংসার’ প্রভৃতি উপন্যাসে গ্রামজীবনের খুঁটিনাটি, সংসার জীবনের হাসিকান্না খুবই বাস্তবভাবে উপস্থাপন করেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। যে-কোনো পাঠকের কাছে তা ভালো লাগতে বাধ্য। এই পর্যায়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস অবশ্যই ‘পথের পাঁচালী’।
(ঘ) চরিত্রচিত্রণের সার্থকতা চরিত্রচিত্রণের ক্ষেত্রে তিনি যেন এক সার্থক ভাস্কর। মানুষের ছোটো ছোটো দুঃখ-ব্যথা, টুকরো কিছু সুখ এবং অনন্য অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে তাঁর গল্প- উপন্যাসের চরিত্র গুলোতে। অপু-দুর্গা-সত্যচরণ- ভানুমতী-দোবরুপান্না-বিপিন-এদের কাউকেই তাই ভোলা অসম্ভব।
(ঙ) গল্প-উপন্যাসের অনুপম ভাষা বিভূতিভূষণের রচনার ভাষা কী যে অনুপম মাদকতাময়, অথচ সহজসরল ও কাব্যিক, তা যে না পড়েছে, সে বুঝবে না। এসব কারণেই তো তিনি আমার প্রিয় লেখক।