অনুবাদ সাহিত্য বাংলা রচনা |
ভূমিকা
অনুবাদ যে-কোনো ভাষার সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করে। এর মাধ্যমেই পাওয়া যায় সৃজনশীলতার নব আস্বাদ, আনন্দ ও বিশ্বলোকের অপার জ্ঞানের স্পর্শ। মাতৃভাষার গণ্ডির বাইরে বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে কৌতূহল এবং তার রসগ্রহণের ইচ্ছাই মূলত মানুষকে অনুবাদ সাহিত্যের দিকে আকর্ষিত করে-এককথায় বলা যায়, অনুবাদকর্মের নেপথ্যে মূলত রয়েছে মানুষের চিরন্তন জ্ঞানের পিপাসা, যা দেশকালের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে নারাজ।
অনুবাদ সাহিত্যের যাত্রা
সংস্কৃত ভাষায় লেখা রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত ও অন্যান্য পুরাণ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যকে এক ধ্রুপদি মহিমা এনে দিয়েছে। এর নেপথ্যে যেমন ছিল ইসলামি রাজাদের হিন্দুকাহিনিগুলির প্রতি আগ্রহ, তেমনই ছিল সমাজ-সংস্কৃতির পুনর্গঠনের তাগিদ। এই অনুবাদগুলির মাধ্যমে আমরা পেলাম কৃত্তিবাস ওঝা, কাশীরাম দাস, মালাধর বসু, শ্রীকর নন্দী প্রমুখ মহান কবিদের অমৃতবচনের স্বাদ।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অনুবাদ সাহিত্য
ইংরেজ আমলের শুরুতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা গদ্যচর্চার আঁতুড়ঘর তৈরি হল। শাসনকার্যের প্রয়োজনে নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের ফারসি থেকে অনুবাদ ‘A Grammar of the Bengali Language’ (১৭৭৮) কিংবা জোনাথান ডানকানের ইম্পে কোডের অনুবাদ (১৭৮৪) ইত্যাদির পাশাপাশি ‘লিপিমালা’, ‘হিতোপদেশ’, ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ প্রভৃতির অনুবাদ কিংবা বাইবেলের বিভিন্ন অংশের অনুবাদ (মঙ্গল সমাচার) বাংলা গদ্যভাষাকে অভিনবত্ব দিয়েছিল। সংস্কৃত ভাষার জ্ঞানদর্শন ব্যাকরণচর্চার বহু গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ (যেমন-ব্যোপদেবের ‘মুগ্ধবোধ’ – কোলব্রুক সম্পাদিত ‘অমরকোষ’ ইত্যাদি) বাঙালির সাহিত্যচর্চাকে সমৃদ্ধ করেছিল।
অনুবাদের ধারা
অনুবাদের বিভিন্ন কারণ সব দেশে সবকালেই ছিল, আছে, থাকবে। অনুবাদ অজানা-অচেনা ভাষার অমূল্য সম্পদকে হাতে এনে দেয়। অনুবাদক নিজগুণে অর্জন করেন সাহিত্যিকের সম্মান। কেন-না অনুবাদকর্মে মিশে যায় অনুবাদকের আপন মনের মাধুরী। এভাবেই বাংলা গদ্যের বিকাশপর্বে আমরা পেয়েছি রামমোহনকে, বেদান্ত-উপনিষদের সমৃদ্ধ অনুবাদে। শকুন্তলার বিরহ, ভ্রান্তিবিলাসের ধাঁধা, সীতার বনবাসের যন্ত্রণা, আখ্যানমঞ্জরীর নূপুরধ্বনিতে বাঙালির হৃদয়কে রসাপ্লুত করলেন অদ্বিতীয় বিদ্যাসাগর।
বিভিন্ন ভাষার অনুবাদ
সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মের অনুবাদে অগ্রণী ভাষা ইংরেজি। বিশ্বের মহান সাহিত্যিকদের বহু রচনা পৃথিবীব্যাপী নানা ভাষার নানা বয়সের পাঠকদের জন্য পরিমার্জিত ও কমবেশি পরিবর্তিতরূপে অনূদিত হয়ে ব্যাপক সমাদর লাভ করে। অনুবাদ ভালো হলে তা মূল রচনার মতোই সমাদৃত হতে পারে। অনুবাদ সাহিত্য তাই যে-কোনো দেশের মূল সাহিত্যধারারই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বাংলা প্রকাশনাক্ষেত্রে দেব সাহিত্য কুটির, আনন্দ পাবলিশার্স, দেজ পাবলিশার্স অফবিট পাবলিশার্স, পাঠ্য অনুবাদ সাহিত্যপ্রকাশে অগ্রণী সংস্থা। বিখ্যাত বাঙালি কবি-সাহিত্যিকরাও নিজেরাই অনুবাদ করতে আগ্রহী হয়ে মাতৃভাষাকে দিয়েছেন অসামান্য সব সৃষ্টি। বুদ্ধদেব বসুর ‘মেঘদূত’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘নাজিম হিকমতের কবিতা’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুইনো এলিজি’, মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভেলিয়র এল্যুইন’ ইত্যাদি অসংখ্য সমৃদ্ধ অনুবাদ সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের গর্ব। ফরাসি সাহিত্যের অনুবাদে কবি অরুণ মিত্র, নারায়ণ মুখোপাধ্যায়, চিন্ময় গুহ এবং স্পেনের কবিতা অনুবাদে পিনাকী ঘোষ ও বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে অন্য মাত্রা সংযোজন করেছেন।
উপসংহার
অনুবাদ আজ বিশ্বজোড়া সাহিত্যধারার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশ্বসাহিত্যের রসাস্বাদনের জন্য অনুবাদ সাহিত্য আজ স্বীয় যোগ্যতাবলেই এক অপরিহার্য স্থান অর্জন করে নিয়েছে।