1905 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় সংঘটিত বিপ্লবের কারণগুলি লেখো |
ভূমিকা:
রশিয়ায় প্রায় তিনশো বছর ধরে জার শাসকগণ স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা কায়েম রেখেছিলেন। জারদের এই শাসনকার্যের মাধ্যম ছিল অভিজাত, ধর্মযাজক, সৈন্যবাহিনী প্রভৃতির দ্বারা পরিচালিত। জারতন্ত্রের স্বৈরাচার এবং দমনপীড়ন নীতির প্রতি রাশিয়ার জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। তাদের এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভই 1905 খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবের রূপ পায়।
1905 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় বিপ্লবের কারণসমূহ:
① রাজনৈতিক কারণ:
1905 খিস্টাব্দে রুশ জার দ্বিতীয় নিকোলাসের শাসনকালে সে দেশে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। জারতন্ত্রের স্বৈরাচারী শাসনকালে রাশিয়ার সাধারণ মানুষের কোনো স্বাধীন অধিকার ছিল না। বিনা কারণে সেদেশের সাধারণ মানুষদের গ্রেপ্তার করে কারারুদ্ধ করা, নির্বাসন দেওয়া, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বিচারব্যবস্থায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা প্রভৃতি কারণে রাশিয়ার সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এমত পরিস্থিতিতে ডেকাব্রিস্ট, নিহিলিস্ট বা নারদনিক আন্দোলনের সূচনা ও প্রসার ঘটতে শুরু করে। এই আন্দোলনগুলির মাধ্যমে রাশিয়া থেকে জারতন্ত্র উচ্ছেদের প্রয়াস চলে। এরই পাশাপাশি উল্লেখ করতে হয় সমাজতান্ত্রিক ‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দল’-এর কথাও। পরবর্তী সময় এই দলটি ‘বলশেভিক’ ও ‘মেনশেভিক’ নামে দুটি স্বতন্ত্র দলে বিভক্ত হয়ে রুশ জনগণকে বিপ্লবের পথে পরিচালিত করে।
② সামাজিক কারণ:
জার শাসিত রাশিয়ার সমাজ দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। একদিকে ছিল সুবিধাভোগী অভিজাতরা এবং অপরদিকে ছিল সুবিধাহীন কৃষকগণ। জার শাসনকালে কৃষকদের শোষণের অন্ত ছিল না। তারা ‘মির’ (গ্রাম্য সমবায়)-দের শোষণের শিকার হত। সে দেশে ভূমিদাস প্রথার উচ্ছেদের পর এই সংগঠনটির দায়িত্ব পড়ে কৃষকদের জমিগুলির দেখাশোনা করার। কিন্তু এই সংগঠন কৃষকদের পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার নীতি নিলে রুশ কৃষকরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। জার শাসিত শাসনতন্ত্রের প্রতি বিপুল সংখ্যক কৃষকদের পাশাপাশি শ্রমিকরাও অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হত। রাশিয়ায় শিল্পায়ন শুরু হলেও জার শাসনকালে সে দেশের শ্রমিকদের স্বার্থ দেখা হত না। অথচ রাশিয়ায় পুঁজি বিনিয়োগকারী বিদেশি শিল্পপতিদের স্বার্থ সংরক্ষণে গুরুত্ব দেওয়া হত। এমত পরিস্থিতিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করা, স্বল্প মজুরি, সামান্য পরিমাণ খাদ্য প্রাপ্তি ইত্যাদি কারণে শ্রমিকরাও জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে 1905 খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবে যোগদান করে।
③ অর্থনৈতিক কারণ:
রাশিয়ার জার দ্বিতীয় নিকোলাস ছিলেন স্বৈরাচারী শাসক। তাঁর রাজত্বকালে মন্ত্রী কাউন্ট উইটি সে দেশের শিল্পায়নে মনোযোগ দিয়েছিলেন। তাঁর গৃহীত নীতির দ্বারা রাশিয়ার শিল্পে বৈদেশিক পুঁজির পরিমাণ বেশ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধি হলেও রাশিয়া অন্যান্য বিদেশি রাষ্ট্রের ঋণজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে রাশিয়ার জাতীয় ঋণের পরিমাণ ক্রমশ বেড়েই চলে। ক্রমবর্ধমান এই বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে জার দ্বিতীয় নিকোলাস রাশিয়ার শ্রমিক ও কৃষকদের ওপর করের বোঝা বৃদ্ধি করেন। এর ফলে সে দেশের শ্রমিক-কৃষকদের আর্থিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। এর পাশাপাশি তৎকালীন রাশিয়ায় অধিকাংশ জমি ছিল ধনী অভিজাতদের হাতে। ফলে আলোচ্য সময় সে দেশে ধনবণ্টনে কোনো সমতা ছিল না। তাই অভিজাত ও রুশ সমাজের উচ্চবিত্তরা একদিকে বিত্তশালী হয়ে উঠছিল, অন্যদিকে কৃষক শ্রমিকদের আর্থিক পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। এই অবস্থায় কৃষক ও শ্রমিকদের ক্ষোভও 1905 খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবে ইন্ধন জোগায়।
④ প্রত্যক্ষ কারণ:
1904 খ্রিস্টাব্দে রুশ-জাপান যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় ঘটেছিল। এই যুদ্ধে জাপানের মতো শক্তির বিরুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় সমগ্র বিশ্বে তার মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করেছিল। এই যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় সে দেশের জারতন্ত্রের দুর্বলতাকে সর্বসমক্ষে প্রকাশ করে। ফলে রাশিয়ায় একটি সংকটময় পরিস্থিতির সূচনা ঘটে। এমত সংকটময় পরিস্থিতিতে ফাদার গ্যাপন (জার দ্বিতীয় নিকোলাসের জনৈক চর) সেন্ট পিটার্সবার্গে বেশকিছু শ্রমিককে একত্রিত করেন। এরপর তিনি ওই শ্রমিকদের নিয়ে দ্বিতীয় নিকোলাসের শীতকালীন প্রাসাদের উদ্দেশ্যে রওক্ষ্ম না দেন। এক্ষেত্রে ফাদার গ্যাপনের অভিপ্রায় ছিল বিভিন্ন দাবি জারের সামনে পেশ করা। কিন্তু জারের সেনাবাহিনী ওই শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে গুলি চালায়। এই ঘটনা ‘রক্তাক্ত রবিবার’ (1905 খ্রিস্টাব্দ) নামে অভিহিত হয়।
উপরোক্ত কারণগুলির সম্মিলিত ফলস্বরূপ রাশিয়ায় 1905 খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল।