১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো – ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে সিপাহি ছাড়াও কৃষক, সাধারণ মানুষ, জমিদার, অভিজাত, রাজা-রানিরাও অংশগ্রহণ করে। এই ঘটনাকে তাই কেউ সিপাহি বিদ্রোহ, কেউ সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া, আবার কেউ কেউ জাতীয় সংগ্রাম বলেছেন।
 
তো চলুন আজকের মূল বিষয় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো পড়ে নেওয়া যাক।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো

ভূমিকা

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে সিপাহি ছাড়াও কৃষক, সাধারণ মানুষ, জমিদার, অভিজাত, রাজা-রানিরাও অংশগ্রহণ করে। এই ঘটনাকে তাই কেউ সিপাহি বিদ্রোহ, কেউ সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া, আবার কেউ কেউ জাতীয় সংগ্রাম বলেছেন। ভারত ইতিহাসে এই বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি নির্ণয় তাই একটি বিতর্কিত বিষয়।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি

নিছক সিপাহি বিদ্রোহ

ঐতিহাসিক চার্লস রেইকস, হোমস, কিশোরীচাঁদ মিত্র, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ম্যালেসন, সৈয়দ আহমদ, রজনীকান্ত গুপ্ত প্রমুখ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে নিছক সিপাহি বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন। এই বক্তব্যের পক্ষে তাঁদের যুক্তি ছিল–

[1] ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চালিকাশক্তি ছিল সিপাহিরা। তাদের অসন্তোষ থেকেই বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল।

[2] এই বিদ্রোহে ভারতীয় জাতীয় চেতনার অগ্রদূত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি যোগদান করেনি।

[3] ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজন্যবর্গ এই বিদ্রোহকে সমর্থন করে। তবে অনেকে শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে এই বিদ্রোহে যোগদান করেছিল।

সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া

বিভিন্ন তথ্যসংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে কিছু ঐতিহাসিক বলেছেন, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা ছিল সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া বা সনাতনপন্থীদের বিদ্রোহ। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন, রজনীপাম দত্ত প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ এ বিষয়ে একমত। লর্ড ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতির ফলে ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, পেশোয়ার দত্তকপুত্র নানাসাহেব তাঁদের রাজ্য হারান। সাতারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। কুশাসনের অজুহাতে অযোধ্যা রাজ্য ইংরেজরা দখল করে। নতুন ভূমিব্যবস্থায় এখানকার তালুকদাররা জমি হারায়। ফলে রাজ্যহারা রাজা-রানি, জমি হারানো তালুকদার ও কৃষক, চাকরি হারানো সৈনিকের দল- সবাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তারা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে অংশ নেয়। রজনীপাম দত্ত, পি সি যোশি এবং তালমিজ খালদুন-এর মতে, ‘১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা ছিল জমি হস্তান্তর ও শ্রেণিসংঘাতের প্রতিক্রিয়ার ফল’। কারণ – দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ, রানি লক্ষ্মীবাঈ বা নানাসাহেব এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাঁদের পুরোনো পদমর্যাদা ফিরে পেতে চেয়েছিলেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার-এর মতে, এই বিদ্রোহ ছিল ক্ষয়ি অভিজাততন্ত্র ও মৃতপ্রায় সামন্তদের ‘মৃত্যুকালীন আর্তনাদ’।

গণবিদ্রোহ

উত্তর ও মধ্য ভারতে সিপাহিদের সঙ্গে স্থানীয় সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে এই বিদ্রোহকে গণবিদ্রোহের রূপ দিয়েছিল। মজফ্ফরনগর, সাহারানপুর, অযোধ্যা, কানপুর, ঝাঁসি প্রভৃতি অঞ্চলে গণবিস্ফোরণ ঘটে। বিহারের পশ্চিম দিকে ও পাটনার বহু জেলায় সাধারণ মানুষ সিপাহিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে। তাই ঐতিহাসিক জন কে, সি এ বেইলি প্রমুখ এই বিদ্রোহের গণচরিত্র লক্ষ করে একে ‘গণবিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করেছেন।

জাতীয় সংগ্রাম

ইংল্যান্ডের টোরি দলের নেতা ডিসরেলি-সহ সমকালীন বিভিন্ন ইংরেজ ঐতিহাসিক, যেমন- নর্টন, ডাফ, আউট্রাম, হোমস, চার্লস বল প্রমুখ এই বিদ্রোহকে ‘জাতীয় সংগ্রাম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁদের মতে–

[1] ভারতীয় সিপাহিরা এই বিদ্রোহ শুরু করলেও পরবর্তীকালে ভারতের বিভিন্ন স্থানের মানুষ এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল। বিশেষত অযোধ্যা, রোহিলাখণ্ড ও বিহারের জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বিদ্রোহে যোগদান করে।

[2] ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, নানাসাহেব, কুনওয়ার সিং প্রমুখ রাজন্যবর্গ, বহু জমিদার ও তালুকদার এই বিদ্রোহে যোগদান করে।

[3] বিদ্রোহীরা দিল্লির সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ‘ভারতের সম্রাট’ বলে ঘোষণা করে বিদেশি প্রভাবমুক্ত এক দেশীয় শাসনব্যবস্থা স্থাপনে উদ্যোগী হয়। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলসও এই বিদ্রোহকে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ আখ্যা দিয়েছেন।

ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম

স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনায়ক দামোদর সাভারকর ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু ঐতিহাসিকরা অনেকে এই মত স্বীকার করেননি। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ‘১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের তথাকথিত স্বাধীনতার যুদ্ধ- না ছিল প্রথম, না ছিল জাতীয় এবং না ছিল স্বাধীনতার যুদ্ধ।’ কারণ–

[1] সমস্ত ভারতবাসী এই বিদ্রোহে অংশ নেয়নি। বরং অনেক ভারতীয় রাজা, শিখ ও গোর্খা সৈনিক বিদ্রোহ দমনে সরকারকে সাহায্য করেছিল।

[2] বিদ্রোহীদের কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল না।

[3] ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের জন্মই হয়নি।

[4] তা ছাড়া ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে স্বাধীনতা সংগ্রাম বললে এর পূর্ববর্তী সমস্ত বিদ্রোহের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। অন্যদিকে ঐতিহাসিক শশীভূষণ রায়চৌধুরী বলেছেন, এই বিদ্রোহ ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় যুদ্ধ এবং গণসংগ্রাম।

কৃষক বিদ্রোহ

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে অনেকে কৃষক বিদ্রোহ বলেও অভিহিত করেছেন। সমকালীন অনেক ইংরেজ কর্মচারীও বলেছেন যে, ব্রিটিশ সরকারের জমি সংক্রান্ত নীতি এই বিদ্রোহে ইন্ধন জুগিয়েছিল। তালমিজ খালদুনের মতে, কৃষকেরা এই বিদ্রোহে মরণপণ সংগ্রাম চালিয়েছিল। এই অবস্থায় জমিদাররা তাদের সংকীর্ণ স্বার্থে ইংরেজদের পক্ষ সমর্থন করে।

মুসলমান চক্রান্ত

কোনো কোনো ঐতিহাসিক এই বিদ্রোহকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের চক্রান্ত বলে উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তানি ঐতিহাসিক আই এইচ কুরেশি, সৈয়দ মইনুল হক ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘মুসলিম চক্রান্ত’ বলে অভিহিত করেন। এই বিদ্রোহে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং অযোধ্যা ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বিদ্রোহীদের তৎপরতা লক্ষ করে এই আখ্যা দেওয়া হয়। কিন্তু ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা ঠিক হবে না। এতে হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই লড়াই করেছিল।

মূল্যায়ন

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের জন্য দেশীয় সিপাহিদের অসন্তোষই মূল কারণ ছিল না। এর মূলে ছিল বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের গভীর অসন্তোষ ও হতাশা। তাদের লক্ষ্য ছিল ইংরেজ শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করা। ঐতিহাসিকদের মতে, এই বিদ্রোহ ছিল অপরিহার্য। কারণ কোনো পরাধীন জাতির পক্ষে চিরকালের জন্য বিদেশি প্রভুত্ব মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। অধ্যাপক রণজিৎ গুহ, গৌতম ভদ্র ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও এই আন্দোলনের গণচরিত্রের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে বলা যায়, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিদ্রোহীদের মধ্যে দেশপ্রেমের কোনো অভাব ছিল না এবং এই আন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ সমবেত হয়েছিল।

FAQs On – মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র আলােচনা করাে

মহাবিদ্রোহ কত সালে সংঘটিত হয়েছিল?

মহাবিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল ১৮৫৭ সালে ।

লখনৌতে সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন কে?

লখনৌতে সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন  বেগম হজরত মহল ।

সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম শহীদ কে?

সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম শহীদ মঙ্গল পান্ডে।

মহাবিদ্রোহের সময় মুঘল সম্রাট কে ছিলেন?

মহাবিদ্রোহের সময় মুঘল সম্রাট ছিলেন বাহাদুর শাহ ।
আপনি আমাদের একজন মূল্যবান পাঠক। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো -এই বিষয়ে আমাদের লেখনী সম্পূর্ণ পড়ার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না।

Leave a Comment