স্বদেশি আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা কী ছিল? এই সময়কার সমিতিগুলির কথা আলোচনা করো। |
ভূমিকা
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড কার্জন বাংলা প্রদেশকে বিভক্ত করেন। প্রতিবাদে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন হয়, যা স্বদেশি আন্দোলন নামেও পরিচিত। এই আন্দোলনের প্রাণশক্তি ছিল বাংলার ছাত্রসমাজ। তারা বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। আর এই সময় বিভিন্ন গুপ্ত সমিতিও গড়ে ওঠে।
স্বদেশি আন্দোলনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা
স্বদেশি আন্দোলন তখনকার বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনে ছাত্রসমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
স্বদেশি ও বয়কট : বাংলার ছাত্রসমাজ এই কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে পথে নামে। বয়কট ছিল বিদেশি পণ্যদ্রব্য বর্জন করার নীতি। ছাত্রসমাজ দল বেঁধে দোকানে দোকানে পিকেটিং করে। তারা দোকানদারদের বিদেশি পণ্যদ্রব্য বিক্রি না করার এবং ক্রেতাদের বিদেশি পণ্যদ্রব্য না কেনার আবেদন জানায়। দোকানের সামনে দীর্ঘকালীন অনশন করে বসে থাকে। ছাত্ররা সরকারি স্কুল-কলেজ ছেড়ে দিয়ে, পথে পথে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে এবং পথসভা করে।
এ ছাড়া ছাত্ররা দেশীয় কাপড়ের কল থেকে কাপড় কিনে মাথায় করে নিয়ে রজনীকান্তের ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গান গাইতে গাইতে কাপড় বিক্রি করতে পথে নামে।
সভা : স্বদেশি আন্দোলনের সময় বাংলাদেশে অনেকগুলি রাজনৈতিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এইসব সভায় উপস্থিত জনতার একটি বড়ো অংশ ছিল ছাত্রদল। সভার বক্তব্যের দ্বারা তারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় এবং আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
সরকারি নিপীড়ন : ছাত্ররাই ছিল স্বদেশি আন্দোলনের মূল শক্তি, তাই তাদের এই আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে একের পর এক জারি করা হয় কার্লাইল সার্কুলার (১৯০৫-এর ১০ অক্টোবর), লিয়ন সার্কুলার (১৯০৫-এর ১৬ অক্টোবর) ও পেডলার সার্কুলার (১৯০৫-এর ২১ অক্টোবর)। এইসব সার্কুলার দ্বারা ছাত্রদের স্বদেশি সভাসমিতিতে যোগদান, ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি দেওয়া এবং বিদেশি পণ্যাগারের সামনে পিকেটিং করা নিষিদ্ধ করা হয়। বলা হয়, এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে বেত্রাঘাত, বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার, এমনকি বিদ্যালয়ের অনুমোদন ও অনুদান বাতিল করা হবে। এরপর সরকার নির্দেশিকা কার্যকর করে। বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ের অনুমোদন বাতিল করে বহু ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়।
জাতীয় শিক্ষা : সরকারি অনাচারের প্রতিবাদে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ নভেম্বর রংপুরে সর্বপ্রথম ‘জাতীয় বিদ্যালয়’ গড়ে ওঠে। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় ৯২ জন সদস্য নিয়ে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
স্বদেশি আন্দোলনের সমসাময়িক সমিতিসমূহ
স্বদেশি আন্দোলনের সময় বেশ কিছু সমিতি কার্যকরী ছিল। সমিতিগুলি হল-
অনুশীলন সমিতি: ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অনুশীলন তত্ত্ব’ এই সমিতির আদর্শ ছিল। সতীশচন্দ্র বসু এই সমিতির প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র এর সভাপতি ছিলেন। বহু ছাত্র এই সমিতির সদস্য ছিল। স্বদেশি আন্দোলনে এই সমিতির অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
যুগান্তর দল: ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে এই বিপ্লবী সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ভগিনী নিবেদিতা, অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্র ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, হেমচন্দ্র কানুনগো প্রমুখ মিলে এই সমিতি গড়ে তোলেন। স্বদেশি আন্দোলনের সশস্ত্র ধারায় এই সমিতির অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য।
অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি: সরকারি সার্কুলারের বিরুদ্ধে শচীন্দ্রপ্রসাদ বসুর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি। এই সমিতির কাজ ছিল কার্লাইল সার্কুলার দ্বারা বিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত ছাত্রদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা, দেশবাসীর মধ্যে স্বদেশি আন্দোলনের আদর্শ প্রচার করা, বিদেশি পণ্যাগারের সামনে পিকেটিং করা এবং গ্রামে ও শহরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বদেশি দ্রব্য সরবরাহ করা।
ডন সোসাইটি: ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ডন সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। জাতীয় শিক্ষার প্রসার ও বয়কট আন্দোলনে স্কুলছুট ছাত্রদের জন্য এই সমিতি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে।
অন্যান্য: এ ছাড়া এ যুগে অশ্বিনীকুমার দত্তের স্বদেশবান্ধব সমিতি, স্বদেশ সেবা সমিতি, শক্তি সমিতি এবং আত্মোন্নতি সমিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। এই সমিতিগুলি প্রধানত শরীরচর্চার কেন্দ্র ছিল।