স্পেনের গৃহযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। |
ভূমিকা:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে স্পেনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক সর্বক্ষেত্রেই তীব্র অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল। স্পেনের রাজা আলফান্সোর অযোগ্যতার ফলে প্রশাসনিক ব্যর্থতা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটকে তীব্রতর করে তোলে। রাজতন্ত্রের ব্যর্থতার সুযোগে একদিকে সমাজতন্ত্রী ও প্রজাতন্ত্রীরা আন্দোলন শুরু করে, অন্যদিকে সামরিক কর্তৃপক্ষ স্পেনের ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। এই অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্পেনীয় মরক্কোয় ‘রিফ’ উপজাতি বিদ্রোহ করে। রাজা আলফান্সো উপজাতি বিদ্রোহ দমন ও দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক অরাজকতার সুযোগে ক্যাটালোনিয়া প্রদেশের সামরিক প্রশাসক প্রিমো-ডি-রিভেরা ক্ষমতা দখল করলে রাজা তা মেনে নিতে বাধ্য হন। রিভেরা অভ্যন্তরীণ সমস্যাসমাধানে ব্যর্থ হওয়ায় গণবিক্ষোভের চাপে 1930 খ্রিস্টাব্দে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
প্রজাতন্ত্র স্থাপন:
রাজা আলফান্সো পরিস্থিতির চাপে পড়ে 1931 খ্রিস্টাব্দে সাধারণ নির্বাচনের আদেশ দেন। নির্বাচনে রাজতন্ত্রীরা পরাজিত হয়। প্রজাতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। জামোরার নেতৃত্বে গঠিত নতুন সরকারের বিরোধিতায় রাজা আলফান্সো পদত্যাগ করলে স্পেনে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রজাতান্ত্রিক সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি হলেন জামোরা এবং প্রধানমন্ত্রী হলেন ম্যানুয়েল অজানা।
প্রজাতান্ত্রিক সরকারের কার্যাবলি :
নতুন প্রজাতান্ত্রিক সরকার কিছু কিছু প্রগতিশীল সংস্কার প্রবর্তন করলেও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সেগুলি ফলপ্রদ না হওয়ায় জনমানসে তা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই পরিস্থিতিতে 1933 খ্রিস্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে প্রজাতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের দ্বারা গঠিত সরকার পরাজিত হয়। দক্ষিণপন্থী দলগুলি একত্রিতভাবে সরকার গঠন করে পূর্বের প্রজাতান্ত্রিক সরকারের সংস্কারগুলি বাতিল করে। দক্ষিণপন্থী সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল কাজের জন্য প্রজাতন্ত্রীরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তুললে দেশজুড়ে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রপতি জামোরা পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে সাধারণ নির্বাচনের আদেশ দেন (1936 খ্রিস্টাব্দ)।
ফ্রাঙ্কোর উত্থান:
স্পেনে কোনো স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় সেখানে ধর্মঘট, লুঠতরাজ, হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য সামাজিক বিপর্যয়ের সব চিহ্নই বর্তমান ছিল। স্পেনের রাজনীতিতে একাধিক দল ছিল, যেমন-কমিউনিস্ট, বাস্ক, ক্যাটালান বিচ্ছিন্নতাবাদী (তারা ফ্রান্সের সীমান্তে বাস্ক ও ক্যাটলান দেশকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন করতে চাইছিল), সমাজতন্ত্রী, নৈরাজ্যবাদী (তাদের দাবি ছিল সরকারের অস্তিত্ব থাকবে না), সিন্ডিক্যালিস্ট (একটি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন), জাতীয়তাবাদী এবং ফ্যালাঙ্গিস্ট (একটি ফ্যাসিস্ট শ্রমিক দল)। এই অসংখ্য দলের উপস্থিতিতে স্পেনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অরাজকতাপূর্ণ। 1936 খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনের আগে প্রজাতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট দল মিলিতভাবে ‘পপুলার ফ্রন্ট’ গঠন করে এবং নির্বাচনে জয়লাভ করে ম্যানুয়েল অজানার নেতৃত্বে ‘পপুলার ফ্রন্ট’ মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি জামোরার সঙ্গে মন্ত্রীসভার বিরোধ দেখা দিলে জামোরাকে পদচ্যুত করে অজানাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয় (এপ্রিল, 1936)। দক্ষিণপন্থীদের প্ররোচনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে পপুলার ফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধিতা শুরু হয়। সরকার বিদ্রোহ দমনে কঠোর দমন নীতি গ্রহণ করে এবং সরকার বিরোধিতার অভিযোগে অনেক সরকারি কর্মচারীকে পদচ্যুত বা অবসর গ্রহণে বাধ্য করা হয়। সরকারের প্রতি আনুগত্যহীনতার অভিযোগে জেনারেল ফ্রান্সিস ফ্রাঙ্কোকে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে বদলি করা হলে সামরিক বাহিনীতে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সামরিক বাহিনী পপুলার ফ্রন্ট মন্ত্রীসভার উচ্ছেদ করতে বদ্ধপরিকর হয়। জেনারেল সানজুরোর নেতৃত্বে মরক্কোয় স্পেনীয় সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করে (18 জুলাই, 1936 খ্রিস্টাব্দ)। ইতোমধ্যে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ থেকে জেনারেল ফ্রাঙ্কো এসে বিদ্রোহে যোগদান করেন। বিদ্রোহ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে জেনারেল সানজুরোর মৃত্যু হলে ফ্রাঙ্কো সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করেন।
গৃহযুদ্ধ:
ফ্রাঙ্কো মরক্কোয় পপুলার ফ্রন্টের পালটা সরকার গঠন করেন। ক্রমে সেনাবাহিনীর বিদ্রোহে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল জড়িয়ে পড়লে স্পেনের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। একদিকে কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী, প্রজাতন্ত্রী ও অন্যান্য প্রগতিশীল দল পপুলার ফ্রন্ট মন্ত্রীসভাকে সমর্থন জানায়। অন্যদিকে দক্ষিণপন্থী ফ্যালাঙ্গিস্ট, রাজতন্ত্রের কার্লিস্ট, অন্যান্য দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী, যাজক, ভূস্বামী, শিল্পপতি প্রমুখ ফ্রাঙ্কোকে সমর্থন জানায়। পপুলার ফ্রন্ট সমর্থকরা প্রজাতন্ত্রী এবং সরকার বিরোধী বিদ্রোহীরা জাতীয়তাবাদী নামে পরিচিত হয়। স্পেনের জনগণ দু-দলে বিভক্ত হয়ে পড়ার ফলে সেখানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। দক্ষিণপন্থীদের ধারণা ছিল কমিউনিস্টরা দেশে রাশিয়ার মতো বলশেভিক বিপ্লব ঘটাতে চাইছে। দক্ষিণপন্থীরা স্পেনে বলশেভিক বিপ্লবের অগ্রগতি রোধ করতে চেয়েছিল। সুতরাং, জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি অজানার নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্রীদের সংঘর্ষ শুরু হলে স্পেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ চলেছিল প্রায় তিন বছর। ফ্রাঙ্কো ইটালি ও জার্মানির সমর্থন লাভ করেন। ফ্রাঙ্কো একদল, একনেতা, একরাষ্ট্র-এই নীতিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। 1939 খ্রিস্টাব্দে স্পেনে ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে একনায়কতন্ত্র স্থাপিত হয়। প্রজাতন্ত্রীদের ওপর নির্মম অত্যাচার করে তিনি অসংখ্য লোককে হত্যা করেন। ফ্রাঙ্কো স্পেনে একনায়কতন্ত্র স্থাপন করলেও তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে স্পেনকে সরিয়ে রেখেছিলেন।