সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বড়োেলাট লর্ড কার্জন বাংলাকে দ্বিধাবিভক্ত করেন। এর প্রতিবাদে বঙ্গভঙ্গবিরোধী বা স্বদেশি আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে বিপ্লববাদের সূত্রপাত হয়। এই সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে বাংলা তথা ভারতীয় নারীসমাজও যুক্ত হয়।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারী

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে প্রথাগত নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি বা নরমপন্থা অনুসরণ করা হয়। এই পদ্ধতিতে কোনো প্রতিকার না পেয়ে বাঙালি যুবসমাজ হতাশ হয়ে পড়ে। তখন তারা দাবি আদায় বা লক্ষ্য অর্জনের জন্য অস্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। ইংরেজ কর্মকর্তাদের হত্যা করার জন্য তারা বোমা-পিস্তলের ব্যবহার করে। নারীরাও এই কাজে পিছিয়ে ছিলেন না।

ভগিনী নিবেদিতা

বিপ্লববাদ প্রচারে ভগিনী নিবেদিতা বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। তিনি ম্যাৎসিনির জীবনীগ্রন্থের একটি কপি অনুশীলন সমিতিকে উপহার দেন। এই গ্রন্থ থেকে বিপ্লবীরা গেরিলা যুদ্ধপদ্ধতি সম্বন্ধে ধারণা লাভ করে। এ ছাড়া ক্রপটকিনের লেখা ‘বিপ্লবীর আত্মকথা’ (Memories of a Revolutionist) এবং ‘রুশ ও ফরাসি কারাগার’ (In Russian and French Prisons) গ্রন্থ দুটিও তিনি বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে উপহার দেন।

সাহায্যকারী

বাংলার নারীরা বিভিন্নভাবে বিপ্লবীদের সাহায্য করেন। কুমিল্লায় মৃণালিনী দেবী, মনোরমা দেবী ও হেমপ্রভা দেবী নিজেদের বাড়িতে অস্ত্র মজুত, বিপ্লবীদের আশ্রয়দান ও অস্ত্র সরবরাহের কাজ করতেন। অনুরূপভাবে ফরিদপুরের সৌদামিনী দেবী, বরিশালের সরোজিনী সেন, ঢাকার ব্রহ্মময়ী সেন, বীরভূমের দুকড়িবালা দেবী নিজ নিজ এলাকায় বিপ্লবীদের সাহায্য করতেন।

বিপ্লবী সংগঠন

কলকাতায় সরলাদেবী চৌধুরাণী বিপ্লবীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তিনি নিজ বাড়িতে আখড়া গড়ে তোলেন। একজন প্রশিক্ষক নিয়োগ করে সেখানে বিপ্লবীদের শরীরচর্চা ও অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া হত। এ ছাড়া সরলাদেবী ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’ ও বীরাষ্টমী ব্রত’ পালন করেন। এভাবে তিনি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলতে সাহায্য করেন।

দীপালি সংঘ

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে লীলা নাগ (রায়) ঢাকায় দীপালি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিসংগ্রামের জন্য নারীদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। এই সংঘে নারীশক্তির জাগরণের জন্য শরীরচর্চা ও অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া হত। এর পাশাপাশি নারীদের উচ্চশিক্ষার জন্য উৎসাহও দেওয়া হত। এই সংঘ ঢাকায় একটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এর শাখাপ্রশাখা গড়ে তোলা হয়। শাখাগুলিতে একই কার্যক্রম অনুসরণ করা হত।

বিশিষ্ট নারী বিপ্লবী

গান্ধিজির অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের হঠাৎ সমাপ্তি জনমনে গভীর হতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি করে। ফলে বিপ্লববাদ আবার জাগ্রত হয়। এই বিপ্লববাদে নারীরাও অংশগ্রহণ করেন।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

বাংলা তথা ভারতের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার একটি বিশিষ্ট নাম। মানিনী চ্যাটার্জি তাঁর ‘Do & Die’ গ্রন্থে তাঁকে ঝাঁসির রানির পর ‘দ্বিতীয় মহিলা শহিদ’ বলে অভিহিত করেছেন।

প্রীতিলতা কলকাতার বেথুন কলেজে ছাত্রী থাকাকালীন বিপ্লববাদের সঙ্গে যুক্ত হন। চট্টগ্রামে সূর্য সেনের বিপ্লবী দল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির সংগঠন গড়ে উঠলে প্রীতিলতা এই সংগঠনে যোগদান করেন। তিনি দীপালি সংঘের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়াও চট্টগ্রাম নন্দনকানন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন।

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৮ এপ্রিল বিপ্লবী সূর্য সেনের দলের সঙ্গে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে অংশগ্রহণ করেন। পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে তিনি একজনকে নিহত ও কয়েকজনকে আহত করেন। শেষে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ না করার উদ্দেশ্যে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন প্রীতিলতা। নারীবিপ্লবী ছিলেন কল্পনা দত্ত। তিনি বেথুন কলেজের বিজ্ঞানের ছাত্রী

কল্পনা দত্ত

সূর্য সেনের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অভিযানের অপর এক ছিলেন। এসময় তিনি ডিনামাইট ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েন। তারপর সূর্য সেনের সহযোগী হিসেবে ব্রিটিশবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। পরে তিনি গ্রেফতার হন এবং বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

অন্যান্য

এ ছাড়া বীণা দাস নামে এক ছাত্রী বাংলার গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে গুলি করেন এবং কুমিল্লার দুই ছাত্রী শান্তি ও সুনীতি জেলাশাসককে গুলি করে হত্যা করেন।

ঝাঁসির রানি বাহিনীর অভিযান

১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারত অভিযান করে। আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত অভিযানে ঝাঁসির রানি ব্রিগেড অংশগ্রহণ করে। কিন্তু ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের প্রবল যুদ্ধে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ক্যাপটেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। এই বাহিনীতে প্রায় ১,৫০০ জন নারী যোগদান করেছিলেন।

মূল্যায়ন

এভাবে নারীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেন। ব্যাপ্তিতে সীমিত হলেও প্রকৃতিগতভাবে তা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য ছিল। বিপ্লববাদ ইংরেজ শাসকদের মনে ভীতির সঞ্চার করেছিল। সেই ভীতিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল নারী বিপ্লবীদের দুঃসাহসিক কার্যকলাপ।

Leave a Comment