সম্পদ সংরক্ষণ বলতে কী বোঝো? সম্পদ সংরক্ষণের পদ্ধতিগুলি আলোচনা করো |
সম্পদ সংরক্ষণ :
অধ্যাপক জিমারম্যানের মতে, আগামী প্রজন্মের জন্য বর্তমান প্রজন্মের ভোগের নিয়ন্ত্রণকে সংরক্ষণ বলে। এই অনুসারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা পূরণ ও দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের উদ্দেশ্যে সম্পদকে মিতব্যয়ীভাবে, যথোপযুক্তভাবে ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ব্যবহার করাকে সম্পদ সংরক্ষণ বলে।
সম্পদ সংরক্ষণের পদ্ধতি (Various methods of Resource Conservation) :
আধুনিক যুগে নানা রকম বিচার-বিশ্লেষণ এবং পরীক্ষানিরীক্ষার পর সম্পদ সংরক্ষণের নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে। যথা–
• সম্পদের অতিব্যবহার কমানো :
সম্পদকে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করতে হলে সম্পদের অতিব্যবহার কমানো দরকার। ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলিতে মাথাপিছু ধাতব ও শক্তিসম্পদের ব্যবহার খুব বেশি। এই ব্যবহারের পরিমাণ যথোপযুক্ত হলে সঞ্চিত সম্পদ আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে।
• দ্রব্যের রূপান্তর ঘটিয়ে ব্যবহার:
কোনো কোনো দ্রব্যকে সরাসরি ব্যবহার না করে রূপান্তর ঘটিয়ে তাদের ব্যবহার করলে কম জিনিস থেকে বেশি কাজ পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কয়লা অথবা খনিজ তৈল সরাসরি ব্যবহার করলে যেখানে বেশি খরচ হয় সেখানে বিদ্যুৎ তৈরি করে ব্যবহার করলে খরচ অনেক কম হয়। ফলে সম্পদের সাশ্রয় হয়ে থাকে।
• অপচয় বন্ধ করা:
সম্পদ আহরণের সময় একটা বড়ো অংশ প্রথমেই নষ্ট হয়ে যায়। অরণ্য থেকে কাষ্ঠ আহরণের সময় একটা বড়ো অংশ বনে পড়ে থাকে এবং পরিবহণের সময় নষ্ট হয়। এ ছাড়া, লৌহ আকরিক, কয়লা ইত্যাদি খনিজ সম্পদ উত্তোলনের সময় তাদের বেশ কিছু অংশ ধুলোয় পরিণত হয়ে নষ্ট হয়। এভাবে সম্পদ যাতে নষ্ট না হয় তার দিকে লক্ষ রাখা উচিত।
• উৎপাদন এবং ভোগের মধ্যে সমতা:
সম্পদের উৎপাদন এবং ভোগের মধ্যে সমতা রক্ষা করা দরকার। যে-কোনো সম্পদের ক্ষেত্রে উৎপাদন এবং ভোগের মধ্যে সমতা না থাকলে ক্রমশ ওই সম্পদ নিঃশেষিত হবে। পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলে কাষ্ঠের উৎপাদন এবং ভোগের মধ্যে সমতা না থাকার দরুন বহু বনভূমি নিশ্চিহ্ন হয়েছে।
• জৈব সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি:
জৈব সম্পদ অর্থাৎ, স্বাভাবিক উদ্ভিদ এবং প্রাণীকুলের মোট উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা সম্ভব হলে সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। অরণ্য সৃষ্টি করে, কৃষি ব্যবস্থা ও পশুপালনের প্রসার ঘটিয়ে এবং সামুদ্রিক জৈব সম্পদের উৎপাদন বাড়িয়ে সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়।
• খনিজ দ্রব্যের পুনর্ব্যবহার:
এমন অনেক খনিজ দ্রব্য আছে যাদের বারবার ব্যবহার করা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, লৌহ-ইস্পাত, তাম্র, সিসা, দস্তা, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি ধাতব পদার্থগুলি একবার ব্যবহার করার পর অব্যবহার্য হয়ে পড়লে তাদের গলিয়ে নিয়ে পুনরায় ব্যবহার করা যায়। তবে এক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যা উন্নত হওয়া প্রয়োজন।
• পুনর্ভব সম্পদের সময়ভিত্তিক এবং পরিকল্পনামাফিক ব্যবহার:
পুনর্ভব সম্পদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সময়ভিত্তিক পরিকল্পনা খুবই দরকার। বনভূমি থেকে কাষ্ঠ সংগ্রহ এবং সমুদ্র থেকে মৎস্য শিকারের সময় লক্ষ রাখা উচিত যাতে অল্প সময়ের মধ্যে বেশি কাঠ কাটা এবং মাছ ধরা না হয়। তা না হলে ভবিষ্যতে উৎপাদন ব্যাহত হবে।
• অপুনর্ভব বা ক্ষয়িষ্ণু সম্পদগুলির বিকল্প ব্যবহার :
কয়লা, আকরিক লৌহ, খনিজ তৈল ইত্যাদি অপুনর্ভব বা ক্ষয়িষু সম্পদের বিকল্প সম্পদগুলিকে ব্যবহার করা উচিত। কয়লার বদলে কাঠকয়লা এবং খনিজ তৈলের বদলে জলবিদ্যুৎ ব্যবহার করা দরকার। ফলে ওই সব সম্পদের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পাবে এবং সংরক্ষণ করা সহজ হবে।
• সম্পদের কার্যকরী ক্ষমতাকে পরিপূর্ণরূপে ব্যবহার :
সম্পদের কার্যকরী ক্ষমতাকে পরিপূর্ণরূপে ব্যবহার করা দরকার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মৃত্তিকার উর্বরা শক্তিকে পরিপূর্ণরূপে কাজে লাগানোর জন্যে শস্যাবর্তন কৃষিপদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়োজন। এর ফলে সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং সহজেই তা সংরক্ষণ করা যায়।
• সম্পদ সংরক্ষণের চেতনা সৃষ্টি:
সবশেষে বলা যায়, সম্পদ সংরক্ষণের চেতনা সৃষ্টিই হল সম্পদ সংরক্ষণের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। সেই কারণে সর্বপ্রথম সম্পদ সংরক্ষণের জন্যে সামাজিক চেতনা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। ইউরোপ এবং আমেরিকার মতো শিল্পোন্নত দেশগুলি আবর্জনার সঙ্গে প্রচুর ধাতব পদার্থ ফেলে দেয়। ফলে ওইসব ধাতব পদার্থ চিরতরে নষ্ট হয়। সুতরাং, যাতে কোনো রকম ধাতব পদার্থ আবর্জনার সঙ্গে ফেলে না দেওয়া হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা দরকার।
বর্তমানে সম্পদ সংরক্ষণের চেতনা সৃষ্টির ফলে সম্পদের অপব্যবহার বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া, সম্পদ সংরক্ষণের জন্যে নানারকম বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপ ও উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যার উদ্ভব হয়েছে। যেমন- পেট্রোল খরচ কমানোর জন্যে বর্তমানে অধিক শক্তিশালী ইঞ্জিনবিশিষ্ট গাড়ি তৈরি হয়েছে। এতে কম জ্বালানি খরচ করে অধিক পথ অতিক্রম করা সম্ভব হচ্ছে। এর ফলে পেট্রোলের খরচ কমার দরুন তার স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।