সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো – ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ‘গিরি’ ও ‘দশনামী’ সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসী এবং ‘মাদারি’ সম্প্রদায়ভুক্ত ফকিরদের নেতৃত্বে যে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল, তা সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
 
তো চলুন আজকের মূল বিষয় সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো পড়ে নেওয়া যাক।

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো
সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা

ভূমিকা

মুঘল যুগের শেষদিকে ভারতের বিভিন্ন ভ্রাম্যমান সন্ন্যাসী ও ফকির সম্প্রদায় বাংলা ও বিহারের নানা অংশে স্থায়ীভাবে বসবাস করত। ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ‘গিরি’ ও ‘দশনামী’ সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসী এবং ‘মাদারি’ সম্প্রদায়ভুক্ত ফকিরদের নেতৃত্বে যে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল, তা সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ। 

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের কারণ

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের পিছনে একাধিক কারণ দায়ী ছিল। যথা–

[1] রাজস্বের চাপ : ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উচ্চহারে রাজস্ব বৃদ্ধি করায় কৃষিজীবী সন্ন্যাসী ও ফকিররা করভারে জর্জরিত হয়ে পড়ে। তা ছাড়া কোম্পানির কর্মচারীরা প্রায়ই ব্যবসায়ী সন্ন্যাসী-ফকিরদের কাছ থেকে রেশম বা রেশমজাত পণ্য বলপূর্বক ছিনিয়ে নিত।

[2] ইজারাদারি শোষণ: সন্ন্যাসী-ফকিরদের অধিকাংশই ছিল কৃষিজীবী। অধিক খাজনা আদায়ের জন্য কোম্পানির ইজারাদারদের শোষণ কৃষকদের ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল।

[3] তীর্থকর আরোপ:
সন্ন্যাসীরা মাঝেমধ্যেই দলবদ্ধভাবে তীর্থে যেত। কোম্পানি সরকার তাদের উপর তীর্থকর ধার্য করে এবং ফকিরদেরও দরগায় যেতে বাধা দেয়।

[4] নির্যাতন: সন্ন্যাসী ও ফকিরদের উপর বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হত।

[5] জমিদারদের আর্থিক অবস্থার বিপন্নতা: আগে সন্ন্যাসী-ফকিররা জমিদারদের কাছ থেকে যেরকম দান বা অর্থসাহায্য পেতেন, পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার জমিদারদের উপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপালে জমিদারদের আর্থিক অবস্থা বিপন্ন হয়ে পড়ে। ফলে তারা আগের মতো সন্ন্যাসীদের অর্থসাহায্য করতে পারতেন না। এতে সন্ন্যাসীদের জীবননির্বাহ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়লে তারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের সূচনা

১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় সন্ন্যাসীরা প্রথম ইংরেজ কুঠির উপর আঘাত করে। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বিদ্রোহীরা এই কুঠিকে তাদের অধিকারে রেখেছিল। তবে ওই মাসের শেষের দিকে ক্যাপটেন গ্রান্টের নেতৃত্বে একদল ইংরেজ সেনা এই কুঠি পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে দিনহাটার সন্ন্যাসী নায়ক রামানন্দ গোঁসাই-এর বাহিনীর সঙ্গে লেফটেন্যান্ট মরিসনের বাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বিদ্রোহীরা পরাস্ত হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সন্ন্যাসীরা ইংরেজদের উপর আক্রমণ করে এবং মরিসনের সৈন্যবাহিনী সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হয়।

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের বিস্তার

ঢাকা থেকে এই বিদ্রোহ শুরু হয় এবং এরপর রাজশাহির রামপুর কুঠি আক্রান্ত হয়। এই বিদ্রোহ দাবানলের মতো বগুড়া, মালদহ, রংপুর, দিনাজপুর, কোচবিহার, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।

১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে সন্ন্যাসী-ফকিরদের মধ্যে আত্মকলহের ফলে বিদ্রোহীরা দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর সন্ন্যাসী-ফকিরেরা পৃথক পৃথকভাবে ইংরেজদের বাধা দেয়। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে বগুড়া জেলায় মঞ্জুরার যুদ্ধে ইংরেজ সেনার গুলিতে আহত হয়ে মজনু শাহ প্রাণত্যাগ করেন। মজনু শাহের পর মুসা শাহ ফকিরদের সংঘবদ্ধ করে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু ইংরেজ বাহিনীর আক্রমণে তিনিও পরাস্ত হন। এরপর ভবানী পাঠক সন্ন্যাসীদের নেতৃত্ব দেন। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে জলযুদ্ধে ভবানী পাঠক পরাজিত ও নিহত হন। তাঁর শিষ্যা দেবী চৌধুরাণী কিছু সময় ধরে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু তিনিও পরাজিত হন।

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের অবসান

ইংরেজদের দমননীতির ফলে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের অবসান হয়। নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দুর্বলতা, যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং সন্ন্যাসী-ফকিরদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদের ফলেই সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ইংরেজি সরকারি নথিপত্রে আর উল্লেখ পাওয়া যায় না। এইভাবে ভারতের প্রথম কৃষক বিদ্রোহের অবসান ঘটে।

মূল্যায়ন

বড়োলাট ওয়ারেন হেস্টিংস প্রমুখ রাজপুরুষরা এই বিদ্রোহকে হিন্দুস্তানের যাযাবর, পেশাদার ডাকাতদের উপদ্রব বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এই মত সত্য নয়। কারণ- বিদ্রোহীদের অনেকক্ষেত্রেই শোষিত কৃষকগণ সাহায্য করেছিল। কেবল লুণ্ঠনকারী হলে তারা এই সাহায্য পেত না। সরকারি ও বেসরকারি দলিল থেকে জানা যায় যে, এই বিদ্রোহ ছিল বাংলা ও বিহারের কৃষকশ্রেণির বিদ্রোহ। ঐতিহাসিক উইলিয়ম হান্টার-ই সর্বপ্রথম সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে কৃষক বিদ্রোহ বলেন (The Annals of Rural Bengal-Hunter)। ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড ও গ্যারেট-ও একে কৃষক বিদ্রোহ বলেছেন। সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কাহিনি অবলম্বনে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস আনন্দমঠ রচনা করেন, যা ছিল বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণা।

আপনি আমাদের একজন মূল্যবান পাঠক। সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো -এই বিষয়ে আমাদের লেখনী সম্পূর্ণ পড়ার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না।

Leave a Comment