লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবাদের বিকাশ আলোচনা করো

লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবাদের বিকাশ আলোচনা করো

লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবাদের বিকাশ আলোচনা করো
লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবাদের বিকাশ আলোচনা করো

ভূমিকা

ইংরেজ শাসনকালে প্রবর্তিত নতুন পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে ভারতীয় সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম হয়। এই শ্রেণি বিভিন্ন কারণে ইংরেজ শাসনের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এ যুগের সাহিত্যে এবং চিত্রকলায়। এইসব সাহিত্যের বিষয়বস্তু ছিল জাতীয় ঐক্য ও দেশের মুক্তি। এই সাহিত্যিকরা পাশ্চাত্যের কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিকদের রচনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, উদারনীতিবাদ সম্বন্ধে তাঁদের ধারণা ছিল। এইসব সাহিত্যিকরা তাঁদের রচনার মাধ্যমে দেশবাসীর দুঃখযন্ত্রণা ফুটিয়ে তোলেন। অপরদিকে চিত্রশিল্পীরা তাঁদের সৃষ্টির দ্বারা ভারতবাসীর মনে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলেন। এইভাবে লেখায় ও রেখায় ভারতীয় জাতীয়তাবোধ বিকশিত হয়।

লেখায় সাহিত্য

জাতীয়তাবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে সাহিত্যের বিশেষ ভূমিকা ছিল। এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল-

আনন্দমঠ

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘আনন্দমঠ’ জাতীয়তাবাদী আদর্শ ও স্বাদেশিকতার বীজমন্ত্র ছিল। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় তিনি ‘বন্দেমাতরম’ সংগীতটি প্রকাশ করেন, যা পরে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে সংযুক্ত হয়। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে যুবসমাজকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের জন্য জাতীয়তাবোধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেন বঙ্কিমচন্দ্র। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, ভারতের বিকাশ হবে দেশীয় ঐতিহ্য অনুসরণ করে। এই উপন্যাসের দেশপ্রেম ও আত্মোৎসর্গের আদর্শ বিপ্লবীদের প্রেরণা জোগায়।

বর্তমান ভারত

স্বামী বিবেকানন্দ বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা ও বক্তৃতার মাধ্যমে ভারতের যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করেন। ‘বর্তমান ভারত’ (১৯০৫ খ্রি.) গ্রন্থে তিনি বলেন, “হে ভারত ভুলিও না- তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত। ভুলিও না নীচ জাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত তোমার ভাই।”

বিবেকানন্দ দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করেন। দেশের মুক্তির জন্য আত্মোৎসর্গের আদর্শ তুলে ধরে তিনি সবাইকে অংশগ্রহণের স্বামী বিবেকানন্দ আহ্বান জানান। সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থের প্রচ্ছদ রাজশক্তির বর্ণনা, ভারতের সমাজ-সংস্কৃতি, ধর্ম ও ভারতীয় জীবনাদর্শ – এই গ্রন্থের মূল বিষয়। বৈদিক যুগ থেকে বর্তমানকাল, ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য থেকে শূদ্র জাগরণ পর্যন্ত ভারতীয় সমাজের রূপরেখা এই গ্রন্থে চিত্রিত হয়েছে।

বিদেশি ইংরেজ শাসনে নির্যাতিত, হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত ভারতবাসীকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি দেশবাসীকে অভীঃ এবং উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত মন্ত্র দেন। তিনি সব দেবদেবীকে বাদ দিয়ে একমাত্র ভারতমাতাকে আরাধ্যা দেবী করতে বলেন। যুবশক্তিকে নিজ বলে বলীয়ান করতে তিনি বলেন, ‘গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলার দ্বারা স্বর্গের কাছাকাছি যাওয়া যায়।’ তাঁর বাণী ছিল বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রেরণার উৎস। তাঁর বাণী হতাশাগ্রস্ত ভারতীয়দের শিরায় মাদকতার সঞ্চার করে। ভারতবাসীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে। এজন্য আর জি প্রধান বিবেকানন্দকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক বলে অভিহিত করেছেন।

গোরা

এক আইরিশ যুবকের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের মানসলোকের প্রতীকী চিত্র হল গোরা উপন্যাস (১৯১০ খ্রি.)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই উপন্যাসের মধ্যে সমকালীন যুগ ও জীবনের প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন। এক দ্বন্দ্ব ও তা থেকে উত্তীর্ণ এক সামগ্রিক পরিমণ্ডল এখানে চিত্রিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের চেতনায় ভারতের অতীত-বর্তমান- ভবিষ্যৎ অখণ্ডভাবে ব্যক্ত হয়েছে। একটি জাতির সামগ্রিক পরিচয় গোরার মধ্য দিয়ে চিত্রিত হয়েছে। এই উপন্যাসে সমকালীন মধ্যবিত্তের মানবতাবোধ পরিস্ফুট হয়েছে। শিক্ষিত বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠা ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ, তার অনুসন্ধানী মনোভাব ও কৌতূহল ফুটে উঠেছে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, রাজনৈতিক টানাপোড়েন, হানাহানি থেকে গোরা মুক্তি পেতে চাইত। গোরার চেতনায় অখণ্ডতাবোধ, দেশপ্রেম নিগূঢ়ভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে।

এই উপন্যাসে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের, সমাজের সঙ্গে ধর্মের, ধর্মের সঙ্গে মানবসত্যের বিরোধ ও সমন্বয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জাতিভেদ, বৈষম্য, অভাব ও দারিদ্র্যের সমাধানের ইঙ্গিতও দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।

এই উপন্যাসে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের একটি সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবধারা, বিক্ষোভ-আন্দোলন, দেশাত্মবোধের প্রথম স্ফুরণের চাঞ্চল্য, ধর্ম, ভাবাবেগ স্থান পেয়েছে। গোরা উপন্যাসের সূচনা ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার মধ্য দিয়ে এবং সমাপ্তি ধর্ম ও বিশ্বমানবতার মধ্য দিয়ে। এখানেই জাতীয়তাবোধের বিকাশে ‘গোরা’ উপন্যাসের সার্থকতা।

রেখায় / চিত্রকলা

ভারতে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে সাহিত্যের মতো চিত্রকলারও বিশেষ অবদান রয়েছে। ভারতীয় জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিকারী চিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি।

ভারতমাতা

জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভারতমাতা’ চিত্রটির মাধ্যমে বিশ শতকে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঘটান। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে অঙ্কিত ‘বঙ্গমাতা’ চিত্রটিই স্বদেশি আন্দোলনের আবহে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতমাতা’ রূপে খ্যাতি লাভ করে।

‘ভারতমাতা’ হলেন ভারতবর্ষের প্রতীক। তিনি গৈরিক বসন পরিহিতা এবং চতুর্ভুজা। চার হাতে তাঁর ধানের গোছা, সাদা কাপড়, পুথি ও জপমালা। অর্থাৎ তিনি তাঁর সন্তানদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও দীক্ষা প্রদান করেন। ভারতমাতা সবুজ পৃথিবীর উপর দণ্ডায়মানা, পায়ের কাছে চারটি পদ্মফুল এবং পিছনে নীল আকাশ।

ব্যঙ্গচিত্র

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্রগুলিও জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাঁর অঙ্কিত রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যামূলক ব্যঙ্গচিত্রগুলির মাধ্যমে তিনি ঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্থার সমালোচনা করেছিলেন। অদ্ভুতলোক, বিরূপ বজ্র, নব হুল্লোড়, State Funeral of H.E. Old Bengal ইত্যাদি এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

মূল্যায়ন

এভাবে দেশীয় লেখক-সাহিত্যিক এবং চিত্রশিল্পীও বঙ্গচিত্রশিল্পীরা তাঁদের সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করতে সাহায্য করেছেন। কাল্পনিক চরিত্রগুলি তখন মূর্ত হয়ে উঠেছে পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে। দেশবাসীর মানসলোেক তখন হয়ে উঠেছে উদ্বেল।

2 thoughts on “লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবাদের বিকাশ আলোচনা করো”

Leave a Comment