রুশ বিপ্লবে (1917 খ্রিস্টাব্দ) লেনিনের ভূমিকা আলোচনা করো

রুশ বিপ্লবে (1917 খ্রিস্টাব্দ) লেনিনের ভূমিকা আলোচনা করো
রুশ বিপ্লবে (1917 খ্রিস্টাব্দ) লেনিনের ভূমিকা আলোচনা করো।

ভূমিকা: 

মহান রুশ বিপ্লবের মহানায়ক ছিলেন ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন। কাজান প্রদেশের এক মধ্যবিত্ত ও বিপ্লবী ঐতিহ্যপূর্ণ পরিবারে তিনি 1870 খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। জার কর্তৃক জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ফাঁসি লেনিনের মনের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। মেধাবী ছাত্র লেনিন জারতন্ত্রের পতন ঘটাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। আইনের ছাত্র লেনিন ছাত্রজীবন থেকে মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলে যোগ দেন। বিপ্লবী কার্যকলাপের জন্য তিনি সুইটজারল্যান্ডে নির্বাসিত হন।

রুশ বিপ্লবে লেনিনের ভূমিকা:

শ্রমিক বিপ্লবের আদর্শ : 

নির্বাসিত অবস্থায় থাকাকালীন রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র গঠনের বিষয়টি বাস্তবায়িত করার জন্য লেনিন চিন্তা করতেন। ‘ইসক্রা’ পত্রিকায় এ সম্পর্কে তাঁর বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তিনি শ্রমিকদের মধ্যে মার্কসীয় তত্ত্ব প্রচারের দ্বারা তাদের শ্রেণি চেতনার জাগরণের ওপর জোর দেন। তাঁর দৃঢ়বিশ্বাস ছিল শ্রমিকগণই হল বিপ্লবের প্রধান হাতিয়ার।

স্বদেশে প্রত্যাবর্তন ও এপ্রিল থিসিসঃ 

1917 খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে লেনিন জার্মানির কাইজার সরকারের সাহায্যে নির্বাসন শেষে স্বদেশে ফিরে আসেন। ইতোমধ্যে রাশিয়ায় মেনশেভিক পরিচালিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এই সরকার দেশের খাদ্য সমস্যা, যুদ্ধ ও যুদ্ধ প্রসূত কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। তিনি এপ্রিল মাসে দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন যে, বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে শ্রমিকদের দ্বারা, শ্রমিকের স্বার্থে সরকারি ক্ষমতা দখল করতে হবে। তিনি এই বিপ্লবের পন্থা সম্পর্কে ইসক্রা পত্রিকায় ‘কী করতে হবে’ শিরোনামে জানিয়েছেন। তিনি দাবি করেন 1917 খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের বিপ্লবে শ্রমিক সংগঠনের লাগাতার ধর্মঘটের ফলে জারতন্ত্রের পতন ঘটেছে। সুতরাং বুর্জোয়া শ্রেণির বদলে জারের পতনের পর রাশিয়ার ওপর বলশেভিকের ক্ষমতা পাওয়া উচিত।

নভেম্বর বিপ্লবে নেতৃত্ব দান: 

‘রুটি, জমি ও শান্তি’ এই ধ্বনি নিয়ে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকগণ নভেম্বর বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিপ্লব জয়যুক্ত হয় ও অস্থায়ী জার প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটে। লেনিন বিপ্লবী সরকারের প্রধান হন। কিন্তু এই নবগঠিত রাষ্ট্রকে বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। লেনিন তাঁর সুষ্ঠু পরিচালনা ও কূটনৈতিক জ্ঞানের দ্বারা রুশ প্রজাতন্ত্রকে বিপদমুক্ত করতে সক্ষম হন।

NEP বা নব অর্থনীতি : 

রাশিয়ার খাদ্য, শিল্প ও অর্থনীতিতে সংকট দেখা দিলে লেনিন পুথিগত কমিউনিজম ছেড়ে 1921 খ্রিস্টাব্দে ‘নব অর্থনীতি’ বা ‘NEP’ (New Economic Policy) গ্রহণ করেন। এর ফলে ছোটো ব্যবসায়ী ও ছোটো চাষি বিপ্লবী সরকারকে স্বাগত জানায়। বাস্তবজ্ঞান ও দূরদর্শিতা সম্পন্ন লেনিন পরিস্থিতি বুঝে মার্কসবাদকে প্রয়োগ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনে মার্কসবাদে সামান্য কিছু পরিবর্তন করতেন বলে লেনিনের নীতিকে মার্কসবাদ ও লেনিনবাদ বলা হয়।

ভার্সাই সন্ধির বিরোধিতা: 

রাশিয়াকে প্যারিসের শান্তি বৈঠকে আহ্বান করার ফলে লেনিন ভার্সাই সন্ধিকে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত বলে অভিহিত করেন। পশ্চিমি ইউরোপীয় দেশগুলি নবগঠিত সোভিয়েত সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। তার প্রতিবাদে তিনি জার্মানির সঙ্গে ‘র‍্যাপেলোর সন্ধি’ স্বাক্ষর করেন।

মূল্যায়ন : 

রাজনৈতিক প্রতিভা, সাংগঠনিক শক্তি, দৃঢ় মনোভাব প্রভৃতি থাকার ফলে লেনিন বহু বাধা অতিক্রম করে সমাজতান্ত্রিক রুশ রাষ্ট্রের পত্তন করেছিলেন। বলশেভিক নেতাদের মধ্যে তিনিই ছিলেন যিনি ভুল করলে তা স্বীকার করে সততা ও সাহসের সঙ্গে নীতি পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখতেন।

অনেকের মতো ট্রটস্কি, স্ট্যালিন প্রভৃতি যোগ্য সহকর্মী থাকার ফলে লেনিন তাঁর স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে পেরেছিলেন। গৃহযুদ্ধের সময় স্ট্যালিনের ‘চেকা’ ও ট্রটস্কির ‘লালফৌজ’ গঠন এর মধ্যে অন্যতম। শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃত লাভ করে ও সোভিয়েত রাশিয়া বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পিতৃভূমি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

Leave a Comment