রুশ-জার্মান সংঘাত সম্পর্কে যা জানো লেখো |
ভূমিকা:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রবল পরাক্রান্ত জার্মান বাহিনীকে সবচেয়ে বেগ দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুদ্ধের গোড়ায় কিন্তু এই দুই দেশ মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। যুদ্ধ শুরুর আগে তিরিশের দশকের মাঝামাঝি স্পেনীয় গৃহযুদ্ধকে কেন্দ্র করে এই দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন বারবার ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডকে অনুরোধ করেছে ভার্সাই চুক্তি ভঙ্গের অপরাধে জার্মানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপীয় শক্তিগুলি তোষণ নীতি পরিত্যাগ করেনি। এই অবস্থায় জার্মানির সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তির মাধ্যমে স্ট্যালিন যুদ্ধের প্রস্তুতিতে কিছুটা সময় নেওয়ার চেষ্টা করেন।
জার্মানির উদ্দেশ্যঃ
বাল্টিক অঞ্চল, ইউক্রেন এবং মস্কো দখল করে পূর্ব দিকে বিস্তারনীতি গ্রহণ ছিল জার্মানির রাশিয়া আক্রমণের উদ্দেশ্য। জার্মানির রাশিয়া আক্রমণ: কয়েক মাসের মধ্যেই জার্মান বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে অনেকটা এগিয়ে যায়। লেনিনগ্রাদ অবরুদ্ধ হয়। ইউক্রেনের বেশ কিছু অংশ জার্মানির অধিকারে আসে। কিন্তু মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপে জার্মান ব্লিৎজ ক্রিগ বা বিদ্যুৎ আক্রমণ যে দ্রুতগতির সাফল্য পেয়েছিল পূর্ব দিকে তা আসেনি। বরং জার্মান বাহিনীর বড়ো অংশ পূর্ব রণাঙ্গনে অংশ নেওয়ায় ব্রিটেন স্বস্তি পায়। জুলাই মাসে ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানির বিরুদ্ধে সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হলেও জার্মান বাহিনীর সাফল্য কিন্তু অব্যাহত ছিল। অক্টোবর মাস থেকে মস্কোর ওপর জোরদার আক্রমণ চালায় তারা। মাস দুয়েকের চেষ্টায় মস্কোর খুব কাছাকাছি পৌঁছোলেও প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি ও প্রবল ঠান্ডার কারণে তারা এই অভিযান পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই সোভিয়েত বাহিনী পালটা আক্রমণ শুরু করে। জার্মান বাহিনী কোনও কোনও জায়গায় আড়াইশো কিলোমিটার পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা অধিকৃত জায়গাগুলিকে দখলে রাখতে পেরেছিল। 1942-এর জুন মাস নাগাদ জার্মানি পূর্ব রণাঙ্গনে প্রায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিল।
আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি:
প্রাথমিকভাবে পিছিয়ে গেলেও স্ট্যালিনগ্রাদ শহরের কাছে সোভিয়েত বাহিনী তাদের চূড়ান্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি নাগাদ স্ট্যালিনগ্রাদের পথে জার্মান-সোভিয়েত তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয়। সোভিয়েত বাহিনী পালটা আক্রমণ শুরু করে এবং স্ট্যালিনগ্রাদের জার্মান বাহিনীকে ঘিরে ফেলতে সক্ষম হয়। 1943 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় জার্মান বাহিনী। স্ট্যালিনগ্রাদ আক্রমণকারী দলটি আত্মসমর্পণ করে। 1943 খ্রিস্টাব্দের বসন্তকালে দুই পক্ষই প্রস্তুত হচ্ছিল চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য। 4 জুলাই জার্মান সৈন্য মস্কোর 450 কিমি দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে সোভিয়েত বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। কিন্তু সোভিয়েত প্রতিরোধ ভেদ করতে তারা সক্ষম হ্যানি। হিটলার অভিযান বন্ধ করতে বাধ্য হন।
জার্মানির পরাজয়ের সূচনা:
ইউরোপের অন্যত্রও অক্ষশক্তি তখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন। হামবুর্গে ব্রিটিশ বিমান হানায় চল্লিশ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। ইটালিতে মুসোলিনি মিত্রপক্ষের হাতে ধরা পড়েন। এই পরিস্থিতিতে 12 জুলাই সোভিয়েত সৈন্য পালটা আক্রমণ শুরু করে। স্মলেনেস্কের কাছে জার্মান প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রতিরোধ চূর্ণ করে তারা এগিয়ে যায়। যুদ্ধ পূববর্তী এস্তোনিয়ার সীমান্তে জার্মান সৈন্য নতুন করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাল্টিক অঞ্চলে সোভিয়েত বাহিনী এর ফলে বেশ কয়েক মাস বাধাপ্রাপ্ত হয়। মে মাসের শেষ দিকে তারা ক্রিমিয়া মুক্ত করে এবং ইউক্রেনের বেশির ভাগ অংশ থেকে জার্মান বাহিনীকে বিতাড়িত করে। রুমানিয়া তখনও জার্মান সৈন্যের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
1944 খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের গোড়ায় পশ্চিম ইউরোপে ব্রিটিশ ও আমেরিকান বাহিনী জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। পূর্ব ও পশ্চিম দুই রণাঙ্গনে জার্মানিকে তখন যুদ্ধ করতে হচ্ছিল। এর ফলে তাদের প্রতিরোধ শক্তি কমে যায়। সোভিয়েত বাহিনী জুন মাসের শেষ সপ্তাহে তাদের আক্রমণ জোরদার করে। বেলারুশের জার্মান বাহিনী পরাজিত হয়। রুমানিয়া এবং বুলগেরিয়ায় অক্ষশক্তির সমর্থক সরকারের পতন হয়। পরবর্তী কয়েক মাসে সোভিয়েত বাহিনীর সাহায্যে এবং স্থানীয় ফ্যাসিস্ট বিরোধী প্রতিরোধ বাহিনীর উদ্যোগে যুগোশ্লাভিয়া, বুলগেরিয়া এবং হাঙ্গেরিতে জার্মান আধিপত্যের অবসান হয়। 1945 খ্রিস্টাব্দের শুরু থেকেই পূর্ব রণাঙ্গনে সোভিয়েত জয়যাত্রা অব্যাহত ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে পূর্ব প্রাশিয়া, সাইলেশিয়া ও পমেরানিয়ায় সোভিয়েত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়। এপ্রিল মাসের মধ্যে ভিয়েনা এবং বার্লিনও সোভিয়েত বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসে।
উপসংহার:
রাইখস্ট্যাগের ওপর সোভিয়েত বাহিনী দখল নেয় 30 এপ্রিল। শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি রুদ্ধশ্বাস ও রক্তক্ষয়ী অধ্যায়।