যান্ত্রিক বা ভৌত আবহবিকার :
উষ্ণতার তারতম্য, আর্দ্রতা ও শুষ্কতার পার্থক্য, শিলাস্তরে চাপের প্রভেদ, তুষার ও লবণের কেলাস গঠন, জৈবিক কার্যকলাপ ইত্যাদির প্রভাবে শিলার আবহবিকার ঘটলে, তাকে যান্ত্রিক বা ভৌত আবহবিকার বলে। যান্ত্রিক আবহবিকারে শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয় এবং পরিশেষে মৃত্তিকায় পরিণত হয়।
যান্ত্রিক আবহবিকারের পদ্ধতিসমূহ ও সৃষ্ট ভূমিরূপ:
(A) তাপীয় প্রসারণ, (B) কেলাসন প্রক্রিয়া, (C) শিলাস্তরের চাপ হ্রাসজনিত প্রক্রিয়া, (D) বৃষ্টিপাতের ক্রিয়া, (E) কলয়েড উৎপাটন এবং (F) কলিকরণ ইত্যাদি পদ্ধতির দ্বারা যান্ত্রিক আবহবিকার সংঘটিত হয়।
(A) তাপীয় প্রসারণ:
(i) প্রস্তর চাঁই খন্ডীকরণ (Block Disintegration):
সংজ্ঞা : উষ্ণতার তারতম্যের কারণে সৃষ্ট প্রসারণ ও সংকোচন বলের প্রভাবে শিলাস্তর যখন বড়ো বড়ো চাঁই-এর আকারে ভেঙে যায়, তখন তাকে প্রস্তুর চাঁই খন্ডীকরণ বলে।
প্রক্রিয়া : দিনের বেলা প্রখর সূর্যতাপে শিলাস্তর উন্ন হয়ে প্রসারিত হয়। এবং রাতের বেলা তাপ বিকিরণ করে সংকুচিত হয়ে পড়ে। এইভাবে, প্রতিনিয়ত অসম প্রসারণ ও সংকোচনের কারণে শিলাস্তরে ব্যাপক পীড়নের সৃষ্টি হয়। পীড়ন নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করলে শিলাস্তরে অসংখ্য উল্লম্ব ও সমান্তরাল ফাটলের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে, এই ফাটল বরাবর বড়ো বড়ো চাঁই মূল শিলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
উদাহরণ: মরু বা মরুপ্রায় অঞ্চলে পাললিক শিলা ও ব্যাসল্ট শিলায় এই আবহবিকার অধিক দেখা যায়।
(ii) শল্কমোচন (Exfoliation):
সংজ্ঞা : শল্ক’ শব্দের অর্থ ‘পেঁয়াজের খোসা’, এবং ‘মোচন’-এর অর্থ ‘ত্যাগ’। উষ্ণতার হ্রাস-বৃদ্ধির কারণে যখন কোনো শিলার উপরের স্তরটি পেঁয়াজের খোসার মতো খুলে যায়, তখন তাকে শল্কমোচন বলে।
প্রক্রিয়া : একই জাতীয় খনিজ দ্বারা গঠিত সমসত্ত্ব শিলার স্তরগুলি যদি সমকেন্দ্রিক হয় তাহলে দিনেরবেলা সূর্যতাপে উপরের স্তরটি ভিতরের স্তরগুলির তুলনায় অধিক উষ্ণ ও প্রসারিত হয় এবং রাতে অধিক শীতল ও সংকুচিত হয়। দীর্ঘ দিন ধরে এভাবে সংকোচন ও প্রসারণের ফলে উপরের স্তরটি পেঁয়াজের খোসার মতো খুলে যায়। এর ফলে, শিলার আকৃতি গোলাকার বা উপগোলাকার হয় বলে শঙ্কমোচনকে গোলাকার বা উপগোলাকার (Spheroidal) আবহবিকার বলে।
উদাহরণ: গ্রানাইট শিলায় এই আবহবিকার অধিক দেখা যায়। তামিলনাড়ুর মহাবলীপুরমের ‘কুছু ভেন্নাই পান্ধ’ নামক বিখ্যাত গ্রানাইট গম্বুজটি এভাবে সৃষ্ট।
(iii) ক্ষুদ্রকণা বিশরণ (Granular Disintegration):
সংজ্ঞা: দিন ও রাতের উষ্ণতার তারতম্যের কারণে সৃষ্ট সংকোচন ও প্রসারণের প্রভাবে যখন কোনো শিলা ফেটে গিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়, তখন তাকে ক্ষুদ্রকণা বিসরণ বলে।
প্রক্রিয়া: বিভিন্ন খনিজ দ্বারা গঠিত বিষমসত্ত্ব শিলার বিভিন্ন খনিজগুলি উষ্ণতার হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে ভিন্ন ভিন্ন হারে সংকুচিত ও প্রসারিত হয়। এইভাবে, বারংবার অসম সংকোচন ও প্রসারণের ফলে শিলাটি বিভিন্ন খনিজের সংযোগ বরাবর সশব্দে ফেটে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় ভেঙে যায়।
উদাহরণ: থর, সাহারা, কালাহারি প্রভৃতি মরুভূমিতে সূর্যাস্তের পর প্রায়ই পিস্তলের গুলি ছোড়ার মতো শব্দ করে শিলা ফেটে যায়।
(iv) গণ্ডশিলা বিদারণ (Boulder Cleaving):
অনেক সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দ্বারা গঠিত শিলার মধ্যে থাকা কোনো বড়ো বোল্ডারের অর্ধেক অংশ ভূপৃষ্ঠে উন্মুক্ত থাকলে ওই অংশ তাপের প্রভাবে ভেঙে গিয়ে ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, এই পদ্ধতিকে গণ্ডশিলা বিদারণ (Boulder Cleaving) বলে।
(v) ডাট ক্র্যাকিং (Dart Cracking):
শিলাস্তরের ফাটলের মধ্যস্থিত পদার্থসমূহ সূর্যতাপে উত্তপ্ত ও প্রসারিত হলে ফাটলরেখা বরাবর শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়, একে ডার্ট ক্ল্যাকিং Dart Cracking) বলে।
(B) কলাসল প্রক্রিয়া:
কেলাসন প্রক্রিয়া দূভাবে সংঘটিত হয় তৃষার কেশাস গঠন এবং করণ কেলাস গঠন।
(i) তূষার কেলাস গঠন বা তুষার কার্য:
তুহিন খণ্ডীকরণ বা তৃষার কীলক গঠন:
পার্বত্য অঞ্চলে বৃষ্টির জল শিলাস্তরের ফাটলের মধ্যে ঢুকে গিয়ে শৈত্যের প্রভাবে তা বরফে পরিণত হয়। জল জমে বরফে পরিণত হলে তা আয়তনে শতকরা দশভাগ বেড়ে যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শিলাস্তরে প্রবিষ্ট তীক্ষ্ণমুখী বরফে ফলাকে তৃষার কীলক বলে। এর ফলে ফাটলের দুপাশের শিলাস্তরে প্রচন্ড চাপের সৃষ্টি করে। এই চাপের প্রভাবে ফাটল ক্রমশ বৃদ্ধি পায় এবং শেষে শিলাস্তর ফেটে গিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোণযুক্ত শিলাখণ্ডের সৃষ্টি হয়। ওই প্রস্তরখণ্ডগুলি পর্বতের পাদদেশ বরাবর সমান্তরালভাবে জমা হলে, তাকে ফেলসেনমার বা ব্লকম্পেড (Felsenmer or Blockspade) বলা হয়। আবার, ওই প্রস্তরখণ্ডগুলি পর্বতের গা বরাবর উপর-নীচে অর্থাৎ, উল্লম্বভাবে সঞ্চিত হলে, তাকে স্ক্রি বা ট্যালাস (Scree or Tallus) বলে।
হিমায়িত স্ফীতি: নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে বৃষ্টির জল সচ্ছিদ্র মৃত্তিকার মধ্যে ঢুকলে শীতকালে তা শৈত্যের প্রভাবে বরফে পরিণত হয়। এর ফলে, স্ফীত বরফের চাপে মাটি ফেটে যে আবহবিকার সংঘটিত হয়, তাকে হিমায়িত স্ফীতি বলে। এরকম ঘটনা ঘটলে চাষ আবাদের পক্ষে বিশেষ সুবিধা হয়।
লবণ কেলাস গঠন: শুষ্ক অঞ্চলে ভৌমজলে দ্রবীভূত লবণ কৈশিক প্রক্রিয়ায় উপরে উঠে আসে এবং শিলাস্তরের ফাটলে লবণের কেলাস গঠিত হয়। ফলে, প্রচণ্ড চাপে শিলা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, একে লবণ কেলাস গঠন বলে।
(C) চাপ হ্রাসজনিত প্রক্রিয়া:
শিলার উপরের চাপ হ্রাস পেলে শিলা প্রসারিত হয় এবং ফেটে যায়। কোনো শিলার ভূপৃষ্ঠের সমান্তরাল ফাটলের মাধ্যমে পাতলা পাতলা পাতের আকারে ভেঙে যাওয়াকে শিটিং (Sheeting) বলে। পাতলা পাতের পরিবর্তে টুকরো টুকরো খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়াকে স্প্যালিং (Spalling) বলে।
(D) বৃষ্টিপাতের ক্রিয়া
বৃষ্টিপাতের ফলে বিভিন্নভাবে যান্ত্রিক আবহবিকার হয়ে থাকে। যথা- কোমল শিলাস্তর দীর্ঘকাল ধরে বৃষ্টির ফোঁটার আঘাতে দুর্বল হয়ে ভেঙে যায়, অনেক সময় শিলার মধ্যস্থিত খনিজ পদার্থ রাসায়নিক বিক্রিয়া ছাড়াই বৃষ্টির জলের সংস্পর্শে আয়তনে বেড়ে যায় এবং অবশেষে ভেঙে যায়, শিলার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্রগুলি বৃষ্টির জলে ভরে যায়, আবার সূর্যের তাপে শুকিয়েও যায়। ক্রমাগত আর্দ্রতা ও শুষ্কতার পরিবর্তনে শিলা টুকরো টুকরো হয়ে যায়, মরু অঞ্চলে অতি উন্ন শিলার উপর হঠাৎ বৃষ্টির জল পড়লে শিলা সংকুচিত হয় ও ফেটে যায়।
(E) কলয়েড উৎপাটন (Coloid Plucking):
কলয়েড’ শব্দের অর্থ ‘আঠা’। খনিজ ও জৈব সংমিশ্রণে সৃষ্ট মাটির একপ্রকার আঠালো উপাদান হল ‘কলয়েড’। এই কলয়েড ধর্মের জন্য শিলার গায়ে লেগে থাকা মাটি শুকিয়ে পড়ে যাওয়ার সময় শিলার গা থেকে কিছু অংশ উৎপাটন করে, একে কলয়েড উৎপাটন (Coloid Plucking) বলে।
(F) কলিকরণ (Slaking)
সমুদ্র উপকূল বরাবর পর্যায়ক্রমে জোয়ার-ভাটা বা সমুদ্রতরঙ্গের প্রভাবে শিলা আর্দ্র এবং সূর্যতাপে শুদ্ধ হয়। ফলে, শিলাস্তরে অসম টান বা পীড়নের সৃষ্টি হয় ও শিলা ফেটে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। এই আবহবিকার প্রক্রিয়াটি কলিকরণ নামে পরিচিত। এছাড়াও,
(G) বুদ্বুদজনিত আবহবিকার
শিলার ফাটলের মধ্যে জলের বুদ্বুদ প্রবেশ করে ফেটে গেলে তা শিলাস্তরে প্রচণ্ড চাপ দিয়ে শিলাকে ফাটিয়ে দেয়।
(H) অন্যান্য যান্ত্রিক আবহবিকার
ক্রমান্বয়ে শিলা আর্দ্র ও শুষ্ক হওয়ার ফলে, ও মরু অঞ্চলে প্রচন্ড উত্তপ্ত শিলার উপর হঠাৎ বৃষ্টির জল পড়লে, দাবানলের প্রচন্ড তাপে, বৃহৎ উল্কাপিণ্ডের সংঘাতে শিলাস্তর ফেটে গিয়ে আবহবিকারপ্রাপ্ত হয়।