মেদিনীপুরের চুয়াড় বিদ্রোহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো। |
ভূমিকা
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ধলভূম ও বর্তমান ঘাটশিলা অঞ্চল নিয়ে জঙ্গলমহল গঠিত ছিল। এই জঙ্গলমহলের অধিকাংশ অধিবাসীদের ইংরেজ ও ইংরেজ সমর্থকরা চুয়াড় বলে অভিহিত করত। কোম্পানি জঙ্গলমহল অঞ্চলে রাজস্ব বৃদ্ধি করলে চুয়াড়রা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিং ধল প্রথম চুয়াড়দের নিয়ে খাজনা বন্ধের আন্দোলন শুরু করেন। দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহ হয়েছিল ১৭৯৮ থেকে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে।
চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ
চুয়াড় বিদ্রোহের কারণগুলি হল–
[1] উচ্চহারে রাজস্ব আদায়: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে চুয়াড়দের জমির উপর উচ্চহারে রাজস্ব ধার্য করে। ফলে করপ্রদানে অনভ্যস্ত চুয়াড়দের উপর এই অত্যধিক রাজস্ব আরোপ তাদের ক্ষিপ্ত করে তোলে।
[2] পাইকান জমি হাতছাড়া চুয়াড়রা জমিদারদের অধীনে পাইক বা সৈনিকের কাজ করত। বেতনের পরিবর্তে তারা নিষ্কর জমি ভোগ করত। এই সমস্ত জমিকে ‘পাইকান জমি’ বলা হত। কিন্তু ঔপনিবেশিক আইন চালু হলে চুয়াড়রা তাদের পাইকান জমি হারায়। ফলে চুয়াড়দের জীবিকা নির্বাহ দুর্বিষহ হয়ে পড়ে।
[3] সূর্যাস্ত আইন: ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারগণ বছরের নির্দিষ্ট দিনে সূর্য ডোবার আগে রাজস্ব দিতে না পারলে চুয়াড়দের জমি সরকার কেড়ে নিত। একে ‘সূর্যাস্ত আইন’ বলা হয়। এরপর সরকার নিলামের মাধ্যমে ওই জমিদারি নতুন জমিদারকে প্রদান করত। এর ফলে মেদিনীপুর অঞ্চলের জমিদার ও কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
[4] রাজস্ব আদায়কারীদের অত্যাচার: কোম্পানির রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারীরা রাজস্ব আদায়ের নামে চুয়াড়দের উপর নির্মম অত্যাচার শুরু করলে চুয়াড়রা স্থানীয় জমিদারদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়।
চুয়াড় বিদ্রোহের বিস্তার
উপরোক্ত কারণগুলির জন্য আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে চুয়াড়রা ইংরেজদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে মেদিনীপুরের রাইপুর পরগনায়। এই চুয়াড় বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন রাইপুরের জমিদার দুর্জন সিং। দুর্জন সিং ঠিক সময় রাজস্ব প্রদান করতে না পারার জন্য কোম্পানি রাইপুরের জমিদারি বাজেয়াপ্ত করে এবং তাদের অনুগত এক জমিদারকে তা প্রদান করে। ক্ষমতাচ্যুত দুর্জন সিং তার অনুগত ব্যক্তিদের নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
[1] দুর্জন সিং-এর নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা রাইপুর পরগনার বিভিন্ন গ্রামে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। বিদ্রোহীরা মেদিনীপুর লুঠ করে ও হত্যালীলা চালায়।
[3] ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে গোবর্ধন দিকপতি নামে এক বিদ্রোহী চন্দ্রকোনায় প্রবেশ করে লুঠপাট চালায়।
[4] অপরদিকে দুর্জন সিং-এর অনুগত লাল সিং ও মোহন সিং নামে দুজন নেতা মেদিনীপুর অঞ্চলে ব্যাপক লুঠপাট চালায়।
চুয়াড় বিদ্রোহ দমন
[1] পুলিশবাহিনী মোতায়েন: চুয়াড় বিদ্রোহ দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশবাহিনী মোতায়েন করে।
[2] থানা গঠন: এইসব উপদ্রুত অঞ্চলে থানা প্রতিষ্ঠা করে তাদের হাতে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশি ব্যবস্থার উপরে জমিদারদের স্থাপন করা হয়।
[3] বিদ্রোহীদের সঙ্গে আপস: পুলিশ দিয়ে চুয়াড় বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হবে না বুঝতে পেরে সরকার জমিদারদের সঙ্গে সমঝোতা করে। তাদের উপর নামমাত্র রাজস্ব ধার্য হয়। তা ছাড়া স্থানীয় সর্দারদের পাইকান জমিগুলিকে করমুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়।
চুয়াড় বিদ্রোহের ফলাফল / গুরুত্ব
[2] নিলাম নীতি ত্যাগ: ব্রিটিশ সরকার এই অঞ্চলে নিলামের মাধ্যমে জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার নীতি ত্যাগ করে।
[3] ‘জঙ্গলমহল’ জেলা গঠন: ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার ১৮নং রেগুলেশন জারি করে উপদ্রুত অঞ্চলগুলিকে নিয়ে জঙ্গলমহল জেলা গঠন করে। এই জেলার সদর দপ্তর হয় বাঁকুড়া। জঙ্গলমহল জেলার প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন হেনরি স্টাচি।