মেটারনিক ব্যবস্থা ও তার পতনের কারণ লেখো।

মেটারনিক ব্যবস্থা ও তার পতনের কারণ লেখো
মেটারনিক ব্যবস্থা ও তার পতনের কারণ লেখো

ভূমিকা : 

অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিক নেপোলিয়ানের পতনের পর অস্ট্রিয়া তথা সমগ্র ইউরোপে বিপ্লবজাত ভাবধারার গতিরোধ করে যে চরম রক্ষণশীল, পুরাতনপন্থী ব্যবস্থা চালু করেছিলেন তা মেটারনিক ব্যবস্থা নামে পরিচিত।

মেটারনিক : 

ক্লেমেন্স ভন মেটারনিক 1773 খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও ইউরোপের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী একজন রক্ষণশীল রাষ্ট্রনেতায় পরিণত হন। আকর্ষণীয়, চারুবাক, দাম্ভিক, চক্রান্তকারী, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব মেটারনিক সম্বন্ধে আরও নানা বিশেষণ ব্যবহার করা হয়। তাঁকে নেপোলিয়ান বিজেতা, কুটনীতির জাদুকর, ইউরোপীয় রক্ষণশীলতার জনক প্রভৃতি নামে ভূষিত করা হয়। 1815-1848 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ছিলেন ইউরোপের অন্যতম নিয়ন্তা। এই পর্বকে তাই মেটারনিকের যুগ বলা হয়। ঐতিহাসিক কেটেলবি বলেছেন, ভিয়েনা সম্মেলনের কূটনৈতিক ঘূর্ণিজলে তিনি মাছের মতো অবাধে সাঁতার কাটতে পারতেন (He could swim like fish in the sparkling whirlpool of Vienna).

মেটারনিক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য: 

মেটারনিক প্রধানত ইউরোপে রক্ষণশীল ব্যবস্থা প্রচলনের চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর প্রচলিত ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল- 

জাতীয়তাবাদের গতিরোধ: 

বহুজাতি অধ্যুষিত অস্ট্রিয়াকে জাতীয়তাবাদের হাত থেকে রক্ষা করে তাকে ঐক্যবদ্ধ রাখা।

রক্ষণশীলতাকে জনপ্রিয় করা : 

ফরাসি বিপ্লবজাত জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, উদারতন্ত্রকে রুদ্ধ করে রক্ষণশীলতাকে জনপ্রিয় করা।

রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা: 

রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে জাতীয়তাবাদকে স্তব্ধ করা।

অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য: 

ইউরোপের রাজনীতিতে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য বজায় রাখা। মেটারনিক তাঁর চিন্তাভাবনাগুলিকে নিজেই প্রয়োগের ব্যবস্থা করেন। তিনি ফরাসি বিপ্লবকে ‘অরাজকতার দূত’, ‘সহস্র মুখওয়ালা দৈত্য’ বলে মনে করতেন। তিনি আধুনিক চিন্তাভাবনাগুলিকে দমন করার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। যেমন-

মেটারনিক ব্যবস্থার প্রয়োগ:

① তিনি ফরাসি বিপ্লবের পূর্ব অবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য পূর্বেকার রাজবংশগুলিকে পুনরায় সিংহাসনে বসান।

② তিনি রাজবংশগুলিকে নির্দেশ দেন, শাসন করুন, কিন্তু পরিবর্তন করবেন না (Govern but Change noth- ing)|

③ অস্ট্রিয়াতে অধ্যাপকদের তিনি বিপ্লবের আদর্শ প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ দেন।

④ অস্ট্রিয়াতে ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, নীতিশাস্ত্র ও স্বাধীন চিন্তার সৃষ্টিকারী বিষয়গুলির পঠনপাঠন বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়।

⑤ তাঁর নির্দেশে শ্রেণিকক্ষে গুপ্তচর নিয়োগ করা হয়। এ ছাড়াও বিদেশি পত্রপত্রিকার প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।

⑥ সংবাদপত্র যাতে আধুনিক চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটাতে না পারে তার জন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়।

① জার্মানিতে কার্লসবাড ডিক্রি ঘোষণা করে ছাত্র-শিক্ষকদের জাতীয়তাবাদ, উদারতন্ত্র থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।

⑧ ইউরোপীয় শক্তি সমবায় ট্রপোর বৈঠকে (1820) খ্রিস্টাব্দ) ঘোষণা করা হয় প্রজাদের সরকার পরিবর্তনের কোনো অধিকার নেই। এই ঘোষণা অনুযায়ী নেপলস ও পিডমন্টের প্রজা বিদ্রোহ; স্পেনের উদারনৈতিক আন্দোলন; পার্মা, মডেনা ও পোপের রাজ্যে সংগঠিত গণ আন্দোলনকে দমন করা হয়।

পতন: 

1848 খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সময় মেটারনিকতন্ত্রের পতন হয়। মেটারনিক ইংল্যান্ডে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। কালের গতির কাছে মেটারনিকতন্ত্র শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।

মেটারনিকতন্ত্রের পতনের কারণ:

① পরিবর্তনকে অস্বীকার : 

মেটারনিকতন্ত্র তৎকালীন পরিবর্তনশীল মানসিকতাকে অস্বীকার করেছিল। জাতীয়তাবাদী ধারণাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে মেটারনিকতন্ত্র নিজের পতন ডেকে এনেছিল।

② সময়ের গতিপ্রবাহকে অস্বীকার : 

সময় অমোঘ, তার গতিকে রুদ্ধ করার চেষ্টায় কালের নিয়মে স্বয়ং মেটারনিককেই নিঃশেষ হয়ে যেতে হয়েছিল।

③ সংস্কারকে অস্বীকার : 

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে সংস্কার প্রয়োজন। মেটারনিকতন্ত্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করায় তার পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।

① জনসমর্থনের অভাব: 

মেটারনিকতন্ত্রকে ইউরোপের সমস্ত দেশ সমর্থন করেনি। মেটারনিক ভয় দেখিয়ে, অত্যাচারের মাধ্যমে তাঁর নীতিকে বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিলেন। তবে দমনপীড়নের দ্বারা ভীতি উৎপন্ন হতে পারে, কিন্তু শ্রদ্ধা আদায় করা যায় না। তাই মেটারনিকতন্ত্রের পক্ষে জনসমর্থন না থাকায় তার পতন হয়েছিল।

⑤ যুগধর্মকে অস্বীকার : 

পরিবর্তন ইতিহাসের প্রধান চালিকাশক্তি। আবার, এই পরিবর্তন যুগের ধর্ম। মেটারনিকতন্ত্র যুগধর্মকে অস্বীকার করায় এর পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।

⑥ জাতীয়তাবাদী অভ্যুত্থান: 

মেটারনিকতন্ত্রের তীব্র চাপ থাকা সত্ত্বেও এসময় ইউরোপে জাতীয়তাবাদী অভ্যুত্থান কিন্তু বন্ধ হয়নি। ফলে ফার্দিনান্দ উদারপন্থী সংবিধান চালু করেন, পোর্তুগালে গণ অভ্যুত্থান হয়, নেপলসে গণজাগরণ ঘটে। এইসব কাজকর্ম মেটারনিকতন্ত্রের পতনকে ত্বরান্বিত করে।

উপসংহার: 

সময় সর্বশক্তিমান তাই কালের গতির কাছে বহু কিছুই নতিস্বীকার করে। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের তরঙ্গাঘাতে মেটারনিকতন্ত্র চুরমার হয়ে যায়। মেটারনিক ইংল্যান্ডে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।

Leave a Comment