মুণ্ডা বিদ্রোহের কারণ কী ছিল? এই বিদ্রোহ সম্পর্কে লেখো। |
ভূমিকা
ভারতের উপজাতি বিদ্রোহগুলির মধ্যে বিরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে মুণ্ডা বিদ্রোহ ছিল অন্যতম উল্লেখযোগ্য। বর্তমান ঝাড়খণ্ডের রাঁচি-সিংভূম অঞ্চলে মুণ্ডারা বসবাস করত। ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে বিরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে মুণ্ডারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহ উলগুলান (প্রবল বিক্ষোভ) নামে পরিচিত।
মুণ্ডা বিদ্রোহের কারণ
মুণ্ডা বিদ্রোহের কারণগুলি হল–
[1] যৌথ কৃষিব্যবস্থায় ভাঙন: মুণ্ডারা জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষিকাজ করত। ব্রিটিশ আমলে তাদের যৌথ কৃষিব্যবস্থা বা খুৎকাঠি প্রথায় ভাঙন ধরে। সরকার জমিতে ব্যক্তিগত ব্যবস্থা চালু করে। ফলে মুণ্ডারা ক্ষুব্ধ হয়।
[2] বেগার প্রথা: জমিদার ও মহাজনরা মুণ্ডাদের উপর নানা ধরনের কর আরোপ করত। তারা মুণ্ডাদের বেত বেগারি বা বিনা মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য করত। এর ফলে মুন্ডাদের মধ্যে অসন্তোষ ঘনীভূত হয়।
[3] মুন্ডাদের আইন ও বিচারব্যবস্থার পরিবর্তন: মুণ্ডাদের নিজস্ব আইন ও বিচারব্যবস্থা ছিল। তারা নিজেদের বিবাদের মীমাংসা নিজেরাই করত। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত আইন ও বিচারব্যবস্থা মুণ্ডাদের উপরেও বলবৎ হয়। ফলে মুণ্ডারা ক্ষুব্ধ হয়।
[4] মুন্ডাদের ধর্মান্তরিতকরণ : ক্যাথলিক, লুথেরান প্রভৃতি খ্রিস্টান মিশনারিরা মুন্ডাদের বিভিন্ন প্রলোভন বা ভয় দেখিয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করত। মিশনারিরা মুণ্ডাদের চিরাচরিত ঐতিহ্য ও ধর্ম সম্পর্কে নানা ধরনের কুৎসা করত। এতে মুণ্ডারা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
[5] মুন্ডাদের নৈতিক অধঃপতন ঘটানো: বহিরাগত দিকু, মহাজন এবং ঠিকাদার শ্রেণির লোকেরা অর্থ উপার্জনের জন্য মুণ্ডাদের এলাকাগুলিতে মদ ও নেশার জিনিস বিক্রি করতে থাকে। এতে মুণ্ডাদের মধ্যে চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটে। মুণ্ডা নেতারা এই অবক্ষয় ঘটানোর বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়।
[6] ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন : ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন দ্বারা মুন্ডাদের কাছ থেকে অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ফলে মুণ্ডাদের জীবন ও জীবিকা সমস্যায় পড়ে।
বিদ্রোহী কার্যকলাপের ধারা
বিদ্রোহী মুণ্ডা দের আগ্রাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল জমিদার ও মহাজন শ্রেণির গৃহ ও কাছারিগুলি। ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহ-র মতে, মুণ্ডারা পরিকল্পিতভাবে শত্রুপক্ষকে চিহ্নিত করে তাদের উপর আক্রমণ শুরু করে। বিদ্রোহী কৃষকদের মধ্যে এইরূপ একটি ধারণা ছিল যে, জমিদার ও ভূস্বামী শ্রেণির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলি আত্মস্থ করতে পারলে তারাও অনুরূপ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠবে।
বিরসার নেতৃত্বে বিদ্রোহের সূচনা
রাঁচির উলিহাতু গ্রামের এক ভাগচাষি সুগান মুণ্ডার পুত্র ছিলেন বিরসা মুণ্ডা। মাত্র ২১ বছর বয়সে বিরসা এক নতুন ধর্মদর্শনের উদ্ভাবন করতে গিয়ে নিজেকে ‘ধরতি আবা’ বা ‘ধরণীর পিতা’ বলে ঘোষণা করেন। স্বাধীন মুণ্ডারাজ্য প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্যে তিনি বিদেশিদের বহিষ্কার ও খাজনা বন্ধের আহ্বান জানান। বিরসা ৬০০০ মুণ্ডাকে নিয়ে একটি সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর গয়া মুণ্ডা সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিরসা ও তাঁর অনুচরেরা ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর রাঁচি ও সিংভূম জেলায় গির্জা, থানা, অফিস আক্রমণ করে ধ্বংস করেন। কিছুদিন বাদে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে। শেষপর্যন্ত ইংরেজ বাহিনীর আক্রমণে সাহসী মুণ্ডাদের পরাজয় ঘটে। বিরসা বন্দি হন এবং জেলেই ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুন তাঁর মৃত্যু হয়।
মুণ্ডা বিদ্রোহের বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য
মুণ্ডা বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্যগুলি হল–
[1] এই বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল দিকু-দের বিতাড়ন, ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং বিরসার শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
[2] গোপন সমাবেশ, আলোচনা, সমবেত প্রার্থনা ইত্যাদির মাধ্যমে মুণ্ডা বিদ্রোহের বাণী ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
[3] মুণ্ডাদের অনুগত অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর প্রতি কোনো বৈরী মনোভাব প্রকাশ করা হয়নি।
মুণ্ডা বিদ্রোহের গুরুত্ব
মুণ্ডা বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম।
[1] ব্রিটিশ সরকার ছোটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন (১৯০৮ খ্রি.) পাস করে মুণ্ডাদের জমিতে খুৎকাঠি স্বত্ব পুনঃপ্রবর্তন করে।
[2] বেত বেগারি প্রথা নিষিদ্ধ হয়।
[3] এই বিদ্রোহের ফলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। এর প্রভাবেই ছোটোনাগপুরের ওঁরাও সম্প্রদায় তানাভকৎ আন্দোলন শুরু করে।
তবে অধ্যাপক সুমিত সরকারের মতে, মুণ্ডা বিদ্রোহের আসল গুরুত্ব হল বিরসার নেতৃত্বে মুন্ডাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ।