মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী জীবন ও কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোচনা করো। |
ভূমিকা
ভারতের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের একটি ধারা বিদ্যমান ছিল। এক্ষেত্রে যেসকল বাঙালি বিপ্লবীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সূর্য সেন।
পূর্ব সমিতি
সূর্য সেন ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রামেই পড়াশোনা করেন এবং চট্টগ্রাম জাতীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। স্কুল শিক্ষক ছিলেন বলে তিনি ‘মাস্টারদা’ নামে অধিক পরিচিত। শিক্ষকতা করার সময় থেকেই তিনি গভীরভাবে বিপ্লবী আদর্শের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
বিপ্লবী জীবন ও কার্যকলাপ
মাস্টারদার আদর্শ: মাস্টারদা বিশ্বাস করতেন ব্রিটিশদের জোর করে এদেশ থেকে না তাড়ালে তারা কিছুতে ভারত ছেড়ে যাবে না। ব্রিটিশদের ভারত থেকে তাড়াতে হলে সশস্ত্র আন্দোলন প্রয়োজন।
‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’ প্রতিষ্ঠা: সূর্য সেন চট্টগ্রামের যুগান্তর গোষ্ঠীর বিপ্লবীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তারা জাতীয় কংগ্রেস-এর গণ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতেন আবার বিপ্লবী ভাবধারায়ও উদ্বুদ্ধ ছিলেন। সূর্য সেন তাদের নিয়ে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন সূর্য সেন, সহ-সভাপতি ছিলেন অম্বিকা চক্রবর্তী। চট্টগ্রাম শহর সংগঠনের দায়িত্বে ছিলেন গণেশ ঘোষ এবং অনন্ত সিংহ। গ্রামীণ সংগঠনের দায়িত্বে ছিলেন নির্মল সেন।
লক্ষ্য: সূর্য সেন ও এই বিপ্লবীদের লক্ষ্য ছিল পরিকল্পিতভাবে চট্টগ্রামে এক সশস্ত্র বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটানো। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে ইংরেজ শাসন লোপ করা এবং চট্টগ্রামকে স্বাধীন অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন: মাস্টারদার পরিকল্পনা ছিল চট্টগ্রাম শহরে ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার লুঠ করা। পরিকল্পনামতো ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল রাত দশটায় বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণ করেন। অস্ত্র লুঠ করার পর বিপ্লবীরা অস্ত্রাগারটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিপ্লবীরা টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, রেল-সহ যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই ঘটনাই সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাসে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন নামে পরিচিত।
অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা: এই সময়ে সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা চট্টগ্রামে একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। এই অস্থায়ী বিপ্লবী প্রজাতান্ত্রিক সরকারের রাষ্ট্রপতি হন মাস্টারদা স্বয়ং। একটি বিপ্লবী ইস্তাহার প্রচারের মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষিত হয়। তার সঙ্গে ‘গান্ধিজি এসে গেছে’ -এই স্লোগান দেওয়া হয়।
জালালাবাদের মুক্তিযুদ্ধ: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর বিপ্লবীরা নিকটবর্তী জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। বিপ্লবীরা টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছিল বলে ইংরেজ সরকার চট্টগ্রামের অভ্যুত্থানের খবর সঙ্গে সঙ্গে পায়নি। কয়েকদিন পর চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা একটি রুশ জাহাজের রেডিয়ো বার্তা থেকে সরকার সেই ঘটনার কথা জানতে পারে। তখন ইংরেজবাহিনী জালালাবাদ পাহাড় ঘিরে ফেলে। বিপ্লবী ও ইংরেজ সেনাদের মধ্যে অসম যুদ্ধ শুরু হয়। প্রথমদিকে বিপ্লবীদের গুলিতে ৮০ জন ইংরেজ সেনা নিহত হয়। তারপর ইংরেজ সৈন্যদের পালটা আক্রমণে ১২জন বিপ্লবী শহিদ হন। কয়েকজন বিপ্লবী গ্রেফতার হন এবং সূর্য সেন পালিয়ে যান।
ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ: পলাতক সূর্য সেন ধলঘাট গ্রামে আত্মগোপন করেন। স্থানীয় নন্দন কানন স্কুলের শিক্ষিকা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার সূর্য সেনের বিপ্লবী মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে চট্টগ্রাম পাহাড়তলি ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। এই আক্রমণে কয়েকজন হতাহত হয় (২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ খ্রি.)। প্রীতিলতা আত্মহত্যা করেন।
মাস্টারদার গ্রেফতার: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর থেকে ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবীদের ধরার জন্য ব্যাপক তল্লাশি শুরু করে। সূর্য সেনকে ধরার জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। অবশেষে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি গৈরলা গ্রামে তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। মাস্টারদার ফাঁসি: গ্রেফতারের পর মাস্টারদার বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়। বিচারে তাঁর ফাঁসির সাজা হয়। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি মধ্যরাতে সূর্য সেনের ফাঁসি কার্যকর হয়।
উপসংহার
এইভাবে এক কর্মময় বিপ্লবীর জীবনাবসান হয়। বিপ্লবী মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও জালালাবাদের যুদ্ধে যে বীরত্ব দেখিয়েছেন তা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়। তিনি ছিলেন ভারতীয় বিপ্লবীদের কাছে মাতৃমুক্তিযজ্ঞে আত্মবলিদানের প্রেরণাস্বরূপ।