মহারাষ্ট্রের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের বিবরণ দাও। |
ভূমিকা
ভারতে দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে মহারাষ্ট্র সবশেষে স্বাধীনতা হারায়। তাই মারাঠাদের মধ্যে স্বাধীনতার আকুতি প্রবল ছিল। বাংলায় অনুশীলন সমিতি নামে বিপ্লবী সমিতি গড়ে ওঠার (১৯০২ খ্রি.) অনেক আগেই মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড উগ্র রূপ লাভ করে।
বাসুদেব বলবন্ত ফাদকে-র ভূমিকা
মহারাষ্ট্রে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা করেন বাসুদেব বলবন্ত ফাদকে (১৮৪৫-৮৩ খ্রি.)। মায়ের অসুস্থতার জন্য ছুটি নামঞ্জুর, বোম্বাই প্রেসিডেন্সির দুর্ভিক্ষে বহু মানুষের মৃত্যুর জন্য তিনি উগ্র ইংরেজবিরোধী হয়ে ওঠেন। শয়নে-স্বপনে, নিদ্রায়-জাগরণে ইংরেজনিধন তাঁর লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এই লক্ষ্যপূরণের জন্য তিনি রামেসিস, কোল, ভিল, পাঠান প্রভৃতিদের নিয়ে এক সশস্ত্র দল গঠন করেন। সরকারি কোশাগার লুঠ, ডাক ও রেল যোগাযোগ বন্ধ করা, জেল ভেঙে বন্দিদের মুক্ত করে দলের সদস্য বৃদ্ধি করা তাঁর অন্যতম লক্ষ্য ছিল। তিনি এইভাবে বৈপ্লবিক কাজ শুরু করেন। কিন্তু ইংরেজ সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে পাঠায়। কারাগারে যক্ষ্মারোগে তাঁর মৃত্যু ঘটে।
বাল গঙ্গাধর তিলক-এর ভূমিকা
বাসুদেব বলবন্ত ফাদকের অনেক পরে মারাঠাদের মধ্যে চরমপন্থা ও উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রচারে বাল গঙ্গাধর তিলক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। মহারাষ্ট্রের হিন্দুদের পারিবারিক গণপতি উৎসবকে তিনি সর্বজনীনভাবে পালনের উদ্যোগ নেন (১৮৯৪ খ্রি.)। তিনি খ্রিস্টান, ইংরেজ ও মুসলিমদের থেকে হিন্দুধর্মকে রক্ষার আহ্বান জানান। মুসলিম মুঘল শক্তির আগ্রাসন থেকে শিবাজি মহারাষ্ট্র ও মারাঠা জাতিকে রক্ষা করেছিলেন। সেই স্মৃতি জাগিয়ে তোলার জন্য তিলক ‘শিবাজী উৎসব’ পালনের ব্যবস্থা করেন (১৮৯৫ খ্রি.)। তা ছাড়া মারহাট্টা ও কেশরী পত্রিকার মাধ্যমে তিনি যুবসমাজের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেন।
চাপেকার ভ্রাতৃদ্বয়-এর ভূমিকা
তিলকের নেতৃত্বে মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়। এই সময় দামোদর হরি চাপেকর ও বালকৃষ্ণ হরি চাপেকর নামে দুই ভাই পুনা শহরে হিন্দুধর্মের অন্তরায় বিনাশী সংঘ নামে একটি গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৯৫ খ্রি.)। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা পুনার প্লেগ কমিশনার র্যান্ড ও আয়স্টি-কে হত্যা করেন। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে এবং বিচারে তাঁদের ফাঁসি হয়। বাল সমাজ: বিপ্লবী আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে বাল সমাজ নামে একটি গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সমিতি বালক ও ছাত্রদের মধ্যে ইংরেজবিরোধী মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করে। ওয়ার্ধা, নাগপুর, অমরাবতী প্রভৃতি শহরে এই সমিতির শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।
আর্যবান্ধব সমাজ
বাল সমাজের পাশাপাশি আর্যবান্ধব সমাজ নামে আরেকটি গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি গড়ে ওঠে। এই সমিতির লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভারত থেকে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটানো। সমিতির সদস্যদের সামরিক শিক্ষা দেওয়া হত। লাহোর, বরোদা, হায়দরাবাদে সমিতির শাখা খোলা হয়। তিলক, যমুনা লাল বাজাজ, লাজপত রায়, ভাই পরমানন্দ ও বাংলার বিপ্লবীদের সঙ্গে এই সমিতির যোগ ছিল। সমিতি সেনা অভ্যুত্থানের একটি চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
বিনায়ক দামোদর সাভারকরের ভূমিকা
মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত বিপ্লবী বিনায়ক দামোদর সাভারকর ও তাঁর ভাই গণেশ সাভারকার ‘মিত্রমেলা’ নামে একটি গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৯৯ খ্রি.)। দেশের তরুণ সমাজকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা, অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া সমিতির লক্ষ্য ছিল। মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে সমিতির বহু শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। আচার্য কৃপালনী, বি জি খের এই সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাশিয়ার নিহিলিস্ট বিপ্লবীদের কাছে বোমা তৈরির কৌশল শেখার জন্য এই সমিতির কিছু সদস্য প্যারিস যান। সাভারকর লন্ডনে গিয়ে বোমা তৈরির কৌশল ভারতে পাঠান (১৯০৬ খ্রি.)। তাঁর অনুগামী মদনলাল ধিংড়া ইংল্যান্ডে স্যার কার্জন উইলিকে হত্যা করেন। তাঁর পাঠানো অস্ত্রের সাহায্যে লক্ষণ কানহেরী নাসিকের জেলাশাসক জ্যাকসনকে হত্যা করেন। সরকার এজন্য নাসিক ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে। লক্ষ্মণ কানহেরীর বিচারে ফাঁসি হয়। এইসব ঘটনায় যুক্ত থাকার অপরাধে সাভারকারের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কিন্তু ছাব্বিশ বছর কারাভোগের পর তিনি মুক্ত হন।
রাসবিহারী বসুর ভূমিকা
১৯১৪-১৫ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত বিপ্লবী পর তিনি মুক্ত হন। রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী আন্দোলনে গতি আসে। তাঁর অন্যতম সহযোগী বিষু গণেশ পিংলে মীরাট সেনাছাউনিতে হামলার উদ্দেশ্যে বোমা নিয়ে ঢুকে পড়েন। কিন্তু তিনি গ্রেফতার হন। লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার বিচারে তাঁর প্রাণদণ্ড হয়।
উপসংহার
জাতীয় রাজনীতিতে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার অনেক আগে মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড শুরু হয়। জাতীয় কংগ্রেসের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের তুলনায় বিপ্লববাদ ও চরমপন্থার আবেদন এখানে প্রবল ছিল।