|
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা আলোচনা করো। |
ভূমিকা
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ভারত ছাড়ো আন্দোলন একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। গান্ধিজি পরিচালিত শেষ গণ আন্দোলন ছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলন। যদিও এই আন্দোলন শুরুর আগেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়, তথাপি এর কর্মসূচি ও নীতি তিনিই নির্ধারণ করেছিলেন। স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলনে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি যুক্ত হয়। শ্রমিকেরাও এই আন্দোলনে যোগদান করে।
কর্মসূচি
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট বোম্বাই অধিবেশন থেকে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। পরদিন (৯ আগস্ট) কংগ্রেসের অন্যান্য নেতারা ১২ দফা কর্মসূচির একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করে। এই প্রস্তাবে গান্ধিবাদী সত্যাগ্রহ, শিল্প ধর্মঘট, রেলপথ ও টেলিগ্রাফ লাইন আক্রমণ, খাজনা বন্ধ ও কর না দেওয়া, সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠা প্রভৃতির কথা বলা হয়।
বোম্বাই: বোম্বাই শহরে গণবিক্ষোভের মধ্য দিয়ে এই আন্দোলন শুরু হয়। ৯ থেকে ১৪ আগস্ট শহরে ব্যাপক গণবিক্ষোভ ঘটে। শ্রমিকশ্রেণি এই বিক্ষোভে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বোম্বাই শিল্পাঞ্চল এবং বন্দর এলাকায় সরকারি প্রশাসন লোপ পায়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ গুলি চালায়। বেশ কয়েকজন শ্রমিক নিহত হয়।
গুজরাট: এই আন্দোলনে গুজরাটের শ্রমিকেরাও অংশ নেয়। আহমেদাবাদে বস্ত্রশিল্পের প্রায় ১,২৫,০০০ শ্রমিক মজদুর মহাজন সংঘের নেতৃত্বে ধর্মঘট শুরু করে। আহমেদাবাদে আজাদ সরকার বা সমান্তরাল প্রশাসন গড়ে ওঠে। শিল্পপতিরা ধর্মঘট ভাঙতে উৎসাহ দেখায়নি। ফলে তিনমাস ধরে শ্রমিক ধর্মঘট চলতে থাকে। এই ধর্মঘটে শ্রমিকেরা মজুরি বৃদ্ধির কোনো দাবি জানায়নি।
বিহার: তৎকালীন বিহারের জামসেদপুরে টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি (TISCO)-র প্রায় ৩০,০০০ শ্রমিক ১০ আগস্ট ধর্মঘট শুরু করে। এই ধর্মঘট ১৩ দিন ধরে চলে। শ্রমিকেরা দাবি জানিয়েছিল যে, জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তারা ধর্মঘট চালিয়ে যাবে। এর ফলশ্রুতিতে ১২ আগস্ট ডালমিয়ানগরে শ্রমিক ধর্মঘট হয়।
মহীশূর: ব্যাঙ্গালোর শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকেরা ধর্মঘটের মাধ্যমে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। তাদের পাশে দাঁড়ায় ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষ। রাজ্যের বিভিন্ন খনিগুলিতেও শ্রমিক ধর্মঘট হয়। এই ধর্মঘটের মোকাবিলার জন্য পুলিশ ও সেনাবাহিনী গুলি চালায়। বহু শ্রমিক আহত হয় ও মারা যায়।
অন্যান্য রাজ্য: ভারতের অন্যান্য রাজ্যের বিভিন্ন শহরে শ্রমিক ধর্মঘট হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- দিল্লি, লখনউ, কানপুর, নাগপুর, মাদ্রাজ, টেনালি, রামনাদ, কোয়েম্বাটোর, কলকাতা ইত্যাদি। এখানকার শ্রমিক ধর্মঘটগুলি স্বল্পস্থায়ী হয়। কারণ- জাতীয় চেতনার সঙ্গে তাদের পেশাগত স্বার্থ জড়িত ছিল।
১১৪৫-৪৭ খ্রিস্টাব্দে শ্রমিক আন্দোলন
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে শ্রমিক আন্দোলনে নতুন পর্বের উন্মেষ ঘটে। আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকদের বিচারকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী যে উত্তাল গণ আন্দোলন হয়েছিল শ্রমিকরাও সেই আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে বোম্বাই ও কলকাতায় বন্দর শ্রমিকরা ইন্দোনেশিয়াগামী জাহাজগুলিতে মাল বোঝাই করতে অস্বীকার করে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে নৌসেনাদের বিদ্রোহের সমর্থনে বোম্বাই-এর শ্রমিকদের ধর্মঘট ও হরতাল বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।
মূল্যায়ন
ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণ আন্দোলন। হতাশা ও অনাগত আশঙ্কা থেকে এই আন্দোলন ইংরেজদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। এই আন্দোলন ছিল প্রধানত শহরকেন্দ্রিক। শহরকেন্দ্রিক শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকেরা এই আন্দোলনে যোগদান করলেও গ্রামীণ কুটিরশিল্পের শিল্পী-কারিগররা এই আন্দোলন থেকে দূরে ছিল। মুসলিম লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি, র্যাডিকাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিও এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি। তাই এই দলগুলির শ্রমিক সংগঠনগুলিও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগদান থেকে বিরত ছিল। যুদ্ধ চলাকালীন উৎপাদন ব্যাহত না করার দিকে সরকারের দৃষ্টি ছিল। তাই নিষ্ঠুর দমননীতির প্রয়োগ করা হয়। তবুও এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে শ্রমিকশ্রেণি নিজেদের জাতীয়তাবোধের পরিচয় দিয়েছিল।