ভারত ইতিহাসে বামপন্থীদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো |
ভূমিকা
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয় দল, আঞ্চলিক দল, উপজাতি গোষ্ঠী, ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং বহু ব্যক্তিবিশেষের অবদান ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির উপর চাপ সৃষ্টি করে। এর প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ। ঔপনিবেশিক সরকার তাদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য শোষক ও অনুগত শ্রেণি সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু বিভিন্ন উপাদানের প্রভাবে ভারতে জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে। উপনিবেশবাদ-বিরোধী সংগ্রাম শুরু হয়। দেরিতে হলেও বামপন্থীরা এই আন্দোলন সমর্থন করে এবং এতে অংশগ্রহণ করে।
কমিউনিস্ট পার্টি
রাশিয়ার তাসখন্দে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এর বিভিন্ন সদস্য গোপনে ভারতে আসে। তারপর তারা লাহোর, মাদ্রাজ, বোম্বাই, কলকাতায় বিভিন্ন কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গড়ে তোলে। এই গোষ্ঠীগুলি কানপুরে এক সম্মেলনে মিলিত হয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করে (১৯২৫ খ্রি.)। এই সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার, অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন হসরৎ মোহানি এবং সাধারণ সম্পাদক হন সচ্চিদানন্দ বিষুঘাটে।
নীতি ও আদর্শ : শ্রেণিহীন ও শোষণহীন সমাজ গঠন, উৎপাদনের দি উপকরণের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী জনগণের আন্দোলনকে সমর্থন, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা, জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, শ্রমিকদের দুর্দশা লাঘব প্রভৃতি এই দলের নীতি, আদর্শ এবং কর্মসূচি ছিল।
শাখা সংগঠন : কমিউনিস্ট পার্টি বিভিন্ন শাখা সংগঠন গড়ে তোলে। মজুর ও শ্রমিকদের জন্য ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি (WPP), গিরনি-কামগড় ইউনিয়ন, কৃষক সভা প্রভৃতি এবং ছাত্রদের জন্য ভারতের ছাত্র ফেডারেশন গঠন করে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা
কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই দল ব্রিটিশ সরকারের রোষে পড়ে। তবুও ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলনে এই দল সীমিত শক্তি নিয়েই পথে নামে।
সাইমন কমিশনের বিরোধিতা : ভারতের শাসনসংস্কারের জন্য সাইমন কমিশন ভারতে আসে। জাতীয় কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট দল কমিশনকে বয়কট করে। এই উপলক্ষ্যে বিভিন্ন শহরের রাজপথে শোভাযাত্রা, প্রতিবাদ সভা সংগঠিত হয়। এক্ষেত্রে ছাত্রসমাজ বিশেষ উদ্যোগ নেয়। এই প্রতিবাদী ছাত্ররা ভারতের ছাত্র ফেডারেশন (SFI) গড়ে তোলে।
সাইমন কমিশন বোম্বাই বন্দরে পৌঁছোলে (৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৮ খ্রি.) কমিউনিস্ট দলের শ্রমিক সংগঠনের উদ্যোগে ৩০,০০০ শ্রমিক পথে নামে। সর্বাত্মক ধর্মঘট করে ‘সাইমন গো ব্যাক’ এবং ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ ধ্বনি দেয়।
পূর্ণ স্বরাজ প্রস্তাব : প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জাতীয় কংগ্রেসের চরম লক্ষ্য ছিল স্বায়ত্তশাসন বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস লাভ করা। অসহযোগ আন্দোলনের পর স্বরাজ্য দল প্রতিষ্ঠিত হলেও তাদের লক্ষ্য একই থাকে। বামপন্থী নেতা হসরৎ মোহানির উদ্যোগেই কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে (১৯২৮ খ্রি.) প্রথম পূর্ণ স্বরাজ বা স্বাধীনতার দাবি ওঠে। পরে কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে (১৯২৯ খ্রি.) তা গৃহীত হয়।
কমিউনিস্ট দলের বিপ্লবী সংগঠন (HSRA) সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সময় সক্রিয় হয়ে ওঠে। ভগৎ সিং-এর নেতৃত্বে বিপ্লবীরা কেন্দ্রীয় আইনসভায় ট্রেড ডিসপিউট বিল এবং পাবলিক সেফটি বিল পাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বোমা বিস্ফোরণ করে, অত্যাচারী পুলিশ সুপার স্ট্যান্ডার্সকে হত্যা করে। লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসি দেওয়া হয়।
আইন অমান্য আন্দোলন : মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় ৩৩ জন দলের নেতা কারাবন্দি হওয়ায় দল দুর্বল হয়ে পড়ে। তবুও বোম্বাই-এ রেলওয়ে মেনস ইউনিয়ন-এর সদস্যরা লাল পতাকা নিয়ে ধর্মঘট করে। শোলাপুরে বস্ত্রশিল্প শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে এবং সমান্তরাল সরকার গড়ে তোলে। সরকার কমিউনিস্ট দলকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে।
CSP প্রতিষ্ঠা : আচার্য নরেন্দ্র দেব, জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি (CSP) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে। কমিউনিস্ট দলের নেতা-কর্মীরা এই দলে মিশে গিয়ে দলের কর্মসূচিকে প্রভাবিত করে।
র্যাডিকাল পার্টি : এম এন রায় এই দল প্রতিষ্ঠা করলে কমিউনিস্টরা তাঁকে সমর্থন জানায়।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী ফ্রন্টে রাশিয়ার মিত্র ছিল ইংল্যান্ড। তাই কমিউনিস্ট দল ইংল্যান্ডের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে। শ্রমিক ধর্মঘট বন্ধ রাখে এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে দূরে থাকে। তবুও কলকাতা ট্রাম পরিবহণ কর্মীরা ধর্মঘট করে এই আন্দোলনকে সমর্থন জানায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে গণ আন্দোলন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ভারতে অভূতপূর্ব গণ আন্দোলন শুরু হয়। বাংলায় বর্গাচাষিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তেভাগা আন্দোলন ও কেরলে ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যে পুন্নাপ্রা-ভায়লার আন্দোলন সংগঠিত হয়। অন্যদিকে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনা অফিসারদের বিচার শুরু হলে রশিদ আলি দিবস পালন, ভারতীয় নৌবাহিনীর ‘তলোয়ার’ জাহাজে ভারতীয় নাবিকদের বিদ্রোহের ক্ষেত্রেও কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ ভূমিকা দেখা যায়। এ ছাড়া তেলেঙ্গানার কৃষক বিদ্রোহের ক্ষেত্রেও এই পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মূল্যায়ন
বহু বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও কমিউনিস্টরা শ্রেণিসংগ্রামের চরিত্র বজায় রাখে। তারা তাদের নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। কমিনটার্নের নির্দেশ ও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কোনো কোনো কার্যক্রম সমালোচিত হয়। কিন্তু তাদের কার্যকলাপ যে জাতীয়তাবাদী ছিল- এ কথা স্বীকার করতেই হয়।