বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স-এর বিষয়ে আলোচনা করো। সূর্য সেনের কৃতিত্ব লেখো। |
ভূমিকা
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সশস্ত্র আন্দোলনের একটি ধারা লক্ষ করা যায়। ভারতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই সশস্ত্র ধারায় বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠনের অবদান ছিল লক্ষণীয়। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দল ছিল এইরকম একটি আঞ্চলিক সংগঠন। এ ছাড়াও সূর্য সেন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি নামে একটি আঞ্চলিক বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন। এদের কার্যকলাপ ব্রিটিশ শাসকদের মনে ভীতির সঞ্চার করে।
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দল
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দল ছিল বাংলাদেশের একটি গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি।
প্রতিষ্ঠা : বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যে প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তার ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন আন্দোলন ও গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি গড়ে ওঠে। ঢাকার মুক্তিসংঘ ছিল সেইরকমই একটি বিপ্লবী সমিতি। হেমচন্দ্র ঘোষ ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে এই সমিতির প্রতিষ্ঠা করেন। পরে এই বিপ্লবী সমিতি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স নামে পরিচিত হয়।
কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশন
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। এই অধিবেশনের সময় সুভাষচন্দ্র বসু একটি স্বেচ্ছাসেবী দল গড়ে তোলেন। ঢাকার মুক্তিসংঘের অধিকাংশ সদস্য এই স্বেচ্ছাসেবী দলে যোগ দেন। মেজর সত্য গুপ্ত তাদের সামরিক কায়দায় প্রশিক্ষণ দেন। এই দলের সর্বাধিনায়ক হন সুভাষচন্দ্র বসু। কলকাতা অধিবেশন শেষ হলে এই দল বিপ্লবী সংগঠনে পরিণত হয়।
কার্যকলাপ
[1] ঢাকা: এই দল ‘অপারেশন ফ্রিডম’ নামে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনার মধ্যে ছিল কারাবন্দিদের উপর পুলিশি নির্যাতনের প্রতিশোধ নেওয়ার কর্মসূচি। এজন্য এই দলের সদস্যরা ইনস্পেকটর জেনারেল অফ পুলিশ লোম্যানকে গুলি করে হত্যা করেন ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে।
[2] কলকাতা: বিনয়কৃয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান করেন ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর। তাঁরা কারা বিভাগের অধ্যক্ষ সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করেন। আরেক সরকারি কর্তা ক্রেগকেও গুলি করেন। এরপর টেগার্ট-এর নেতৃত্বে এক পুলিশবাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে। রাইটার্স বিল্ডিং-এ দু-পক্ষে গুলিবিনিময়ের ঘটনা অলিন্দ যুদ্ধ নামে পরিচিত। বিনয় ও বাদল আত্মহত্যা করলেও দীনেশের আত্মহত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরে দীনেশের ফাঁসি হয়।
[3] মেদিনীপুর: বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের সদস্য বিমল দাশগুপ্ত জেলাশাসক পেডিকে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে হত্যা করেন। প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য জেলাশাসক ডগলাসকে হত্যা করেন ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে। অনাথ পাঁজা ও মৃগেন দত্ত জেলাশাসক বার্জকে হত্যা করেন ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে।
সূর্য সেনের কৃতিত্ব
বাংলাদেশের সশস্ত্র বিপ্লবী কার্যকলাপের ইতিহাসে সূর্য সেনের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি চট্টগ্রামের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। এজন্য তিনি ‘মাস্টারদা’ নামে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি প্রথমে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে একটি গুপ্ত বিপ্লবী দল গড়ে তোলেন। এজন্য ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। বিচারে তিনি মুক্তিলাভ করেন। তারপর চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের নিয়ে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি নামে একটি দল গড়ে তোলেন।
সূর্য সেনের পরিকল্পনা ছিল চট্টগ্রাম থেকে ইংরেজ প্রশাসন লোপ করা। তিনি আশা করেছিলেন যে, এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে দেশের অন্যান্য স্থানের বিপ্লবীরা ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটাবে। এভাবে ভারতে ইংরেজ রাজত্বের অবসান ঘটবে।
এই লক্ষ্যে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পরিকল্পনা করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল রাত্রিতে তাঁর নেতৃত্বে বিপ্লবীরা সদলবলে পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে টেলিগ্রাফ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন এবং অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেন। অনন্ত সিং, গণেশ ঘোষ, কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ সহযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেন। তিনি এখানে প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। সূর্য সেন নিজেকে এই সরকারের প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা করেন। তারপর ইংরেজ সৈন্যরা পাহাড় ঘিরে ফেললে দু-পক্ষে যুদ্ধ শুরু হয়। এই অসম যুদ্ধে বেশ কয়েকজন সহযোদ্ধা শহিদ হন। সূর্য সেন-সহ কয়েকজন পালিয়ে যান। কিন্তু পরে সূর্য সেন ধরা পড়েন। বিচারে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি মাস্টারদার ফাঁসি হয়।
মূল্যায়ন
ভারতীয় বিপ্লববাদের জনক বাসুদেব বলবন্ত ফাদকে বিপ্লবের যে আগুন জ্বেলেছিলেন তা ভারতের পূর্বপ্রান্তেও ছড়িয়ে পড়েছিল। বাঙালি বিপ্লবীরা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে ইংরেজ সরকার ও তার সাম্রাজ্যবাদকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের শক্তি আর বিপ্লবীদের আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।