বিপ্লবী বিনয়, বাদল ও দীনেশের বৈপ্লবিক কার্যকলাপের বিবরণ দাও

বিপ্লবী বিনয়, বাদল ও দীনেশের বৈপ্লবিক কার্যকলাপের বিবরণ দাও
বিপ্লবী বিনয়, বাদল ও দীনেশের বৈপ্লবিক কার্যকলাপের বিবরণ দাও।

ভূমিকা

বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্নিযুগের তিন জন বিখ্যাত বিপ্লবী হলেন- বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত এবং দীনেশ গুপ্ত। এঁরা বিনয়-বাদল-দীনেশ বা সংক্ষেপে বি-বা-দী নামে বিখ্যাত। এঁদের বিখ্যাত বৈপ্লবিক কার্যকলাপ ছিল মহাকরণ বা রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান, যা ইতিহাসে অলিন্দ যুদ্ধ নামে পরিচিত।

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দল

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের সময় সুভাষচন্দ্র বসু এক স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গড়ে তোলেন। অধিবেশন শেষ হলে হেমচন্দ্র ঘোষ এই বাহিনীর কিছু সদস্য নিয়ে ঢাকায় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দল গঠন করেন। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা দেশসেবায় নিবেদিত ছিলেন। জাতীয় কংগ্রেসের আন্দোলনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে এই গোষ্ঠীর সদস্যরা বিপ্লবী ভাবাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। সূর্য সেন-এর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ঘটনায় এই গোষ্ঠীর সদস্যরা প্রভাবিত হন। তাঁরাও এই ধরনের সশস্ত্র অভিযানের পরিকল্পনা করেন।

বিনয় বসু

বিনয়-এর প্রকৃত নাম বিনয়কৃষ্ণ বসু। তিনি মিডফোর্ড মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। এই সময় তিনি ঢাকায় বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের সংস্পর্শে আসেন। বিনয় ও তাঁর সহযোদ্ধারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা করেন। তাঁরা অত্যাচারী ইনস্পেকটর জেনারেল লোম্যানকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এই সহকর্মীকে দেখতে লোম্যানের মিডফোর্ড হাসপাতালে আসার কথা ছিল। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিনয় তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। তিনি লোম্যানকে খুব কাছ থেকে গুলি করেন। ঘটনাস্থলেই লোম্যানের মৃত্যু হয় এবং পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট হাডসন গুরুতর আহত হন। এরপর বিনয় ঢাকা থেকে কলকাতায় পালিয়ে আসেন।

বাদল গুপ্ত

বাদল গুপ্তের আসল নাম সুধীর গুপ্ত। তিনি বিক্রমপুর এলাকার শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি স্কুলে পড়ার সময় শিক্ষক নিকুঞ্জ সেনের সংস্পর্শে বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষিত হন। তিনি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগদান করেন।

দীনেশ গুপ্ত

দীনেশ গুপ্ত বিক্রমপুর এলাকার যশোলং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাকনাম ছিল নসু। তিনি গৌরিপুর ও ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে লেখাপড়া করেন। ছেলেবেলা থেকেই নির্ভীক ও সুবক্তা। ছোটো থেকেই তাঁর মনে স্বদেশচেতনা ও ব্রিটিশবিরোধী আদর্শ সঞ্চারিত হয়েছিল। তিনি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের সঙ্গে যুক্ত হন। পরে পড়াশোনার জন্য চলে আসেন মেদিনীপুরে।

রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান

বিপ্লবী বিনয়, বাদল ও দীনেশের বিখ্যাত বৈপ্লবিক কাজ হল কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান। বিনয়, বাদল ও দীনেশ ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় কলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করেন। বিপ্লবীদের লক্ষ্য ছিল কারা বিভাগের অত্যাচারী ইন্সপেকটর জেনারেল কর্নেল সিম্পসনকে হত্যা করা। তাঁরা সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করেন।

অলিন্দ যুদ্ধ

পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশ বাহিনী বিপ্লবীদের উপর পালটা আক্রমণ চালায়। রাইটার্স বিল্ডিং-এর বারান্দায় বা অলিন্দে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বলে, একে অলিন্দ যুদ্ধ বলা হয়।

অলিন্দ যুদ্ধের পরিণতি

এই ঘটনার পর বিপ্লবীরা গ্রেফতারি এড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। বাদল পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। বিনয় ও দীনেশ নিজেদের গুলিতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। বিনয় হাসপাতালে মারা যান। দীনেশ বেঁচে যান এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।

উপসংহার

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বিপ্লবী বিনয়, বাদল ও দীনেশ স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁরা দুঃসাহসিক অভিযান ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এই বিপ্লবী ত্রয়ীকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারের নাম বদলে বিনয়- বাদল-দীনেশ বাগ (বি-বা-দী বাগ) রাখা হয়েছে।

Leave a Comment