বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও
বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও

ভূমিকা

নমঃশূদ্র হল হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি বড়ো জনগোষ্ঠী। তাদের আদি বাসস্থান ছিল যশোহর, খুলনা, বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিংহ এবং ফরিদপুর -এই ছয়টি জেলায়। ১৮৭২-৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের সূচনা হয়। এই অঞ্চলের এক গ্রামের এক বিশিষ্ট নমঃশূদ্রের মায়ের শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান ছিল। এই অনুষ্ঠানে উঁচু জাতের লোকেরা আসতে অস্বীকার করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নমঃশূদ্ররা তাদের সঙ্গে সমস্ত রকম সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। উঁচু জাতের ঘরে নমঃশূদ্ররা কেনোরকম কাজ করতে অস্বীকার করে। এই আন্দোলন অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তবে এরপরে এদের মধ্যে মতুয়া নামে এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। নমঃশূদ্রদের প্রধান ধর্মগুরু ছিলেন শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর ও তাঁর পুত্র শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর।

নমঃশূদ্র আন্দোলনের সূচনাপর্ব

উনিশ শতকের শেষদিকে নমঃশূদ্রদের সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়। নমঃশূদ্ররা ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে একটি সমিতি গঠন করে এবং আন্দোলনের প্রচারের জন্য ‘উন্নয়নী সভা’-র আয়োজন করা হয়। তাদের আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যাত্রা-অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং প্রতি পরিবার থেকে প্রতি সপ্তাহে ‘মুষ্টি’ সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়।

অল ইন্ডিয়া নমঃশূদ্র অ্যাসোসিয়েশন গঠন

পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার হরিচাঁদ ঠাকুর সমস্ত নিপীড়িত সম্প্রদায়কে নতুন জীবনদর্শনে উদ্বুদ্ধ করে তাদের মধ্যে আত্মশক্তি ও আত্মমর্যাদাবোধের বিকাশ ঘটান। তিনি মতুয়া নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর মতুয়া আন্দোলন ও মতাদর্শকে জোরদার করে তোলেন। তাঁর নেতৃত্বে নমঃশূদ্র আন্দোলন আরও এগিয়ে যায় এবং ক্রমশ এক স্পষ্ট রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ ধারণ করে। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল নমঃশূদ্র অ্যাসোসিয়েশন (Bengal Namasudra Association) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আন্দোলন দলিত নেতা আম্বেদকরের নেতৃত্বাধীন সর্বভারতীয় দলিত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়।

নমঃশূদ্রদের সামাজিক আন্দোলন

নমঃশূদ্ররা তাদের অসম্মানজনক ‘চণ্ডাল’ নামের পরিবর্তে নতুন ‘নমঃশূদ্র’ নামের অনুমোদন চেয়েছিল। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারিতে তাদের ‘নমঃশূদ্র’ বলে চিহ্নিত করা হয়।

নমঃশূদ্ররা তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য নানা ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতীক গ্রহণ করতে থাকে।

[1] তারা নিজেদের ব্রাহ্মণ বলে দাবি করে এবং তার সপক্ষে প্রমাণ দাখিল করে।

[2] তারা ব্রাহ্মণদের মতো উপবীত ধারণ – করা শুরু করে।

[3] পরিবারের মহিলাদের বাজারে যাওয়া বন্ধ করে।

[4] এগারো দিন অশৌচ পালন করে।

আসলে নমঃশূদ্ররা উচ্চবর্ণের ক্ষমতার প্রতীকগুলিকে অর্থহীন করে দিতে চেয়েছিল। যেমন- উচ্চবর্ণের মতো নমঃশূদ্ররা উপবীত ধারণ করে এক ধরনের সামাজিক প্রতিবাদ শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সমাজের উঁচু-নীচুর বিভেদ দূর করা।

নমঃশূদ্রদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আন্দোলন

নমঃশূদ্র নেতারা তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্যও সচেষ্ট হয়েছিলেন। তারা বুঝেছিলেন যে, নমঃশূদ্রদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য শিক্ষা ও চাকরির প্রয়োজন। তাদের চাকরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার কারণ ছিল উঁচু জাতের লোকের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতা। অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পক্ষপাতিত্ব চাকরির ক্ষেত্রে নমঃশূদ্র বা দলিতদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ ছিল। এজন্য নমঃশূদ্র নেতারা সরকারের কাছে কিছু সুযোগসুবিধা দাবি করেছিল।

নমঃশূদ্রদের রাজনৈতিক বিষয়ে আন্দোলন

নমঃশূদ্ররা রাজনৈতিক দাবি আদায়ের জন্যও আন্দোলন করে। তারা স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলিতে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব দাবি করে। ১৯১৭ ও ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে দুটি সম্মেলনে সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের দাবি তোলে তারা। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের শাসনসংস্কারে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভায় অনুন্নত শ্রেণির একজন প্রতিনিধি মনোনয়নের নীতি স্বীকৃত হয়। কিন্তু নির্বাচনে নমঃশূদ্র অধ্যুষিত এলাকাগুলি থেকে বর্ণহিন্দু প্রার্থীরাই নির্বাচিত হতেন।

ব্রিটিশ সরকারের প্রতি নমঃশূদ্রদের আস্থা

নমঃশূদ্ররা তাদের রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। তারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখত। কারণ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলিকে তারা হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণির আন্দোলন বলে মনে করত। তা ছাড়া তারা মনে করত ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা অতীতের শাসন থেকে উন্নত।

এই কারণে তারা স্বদেশি আন্দোলন, হোমরুল আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন প্রভৃতির বিরোধিতা করেছিল। নমঃশূদ্ররা ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতিকে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু ড. আম্বেদকর যখন বাধ্য হয়ে গান্ধিজির সঙ্গে পুনা চুক্তি স্বাক্ষর করেন তখন তারা এর বিরোধিতা করেছিল।

নমঃশূদ্রদের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নমঃশূদ্ররা কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছিল। কিন্তু ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। কংগ্রেসের নবনির্বাচিত সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মার্চ অ্যালবার্ট হলের এক সভায় গুরুচাঁদ ঠাকুরকে ‘অতিমানব’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন যে, গুরুচাঁদ বাংলার হিন্দুসমাজে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছেন। এই সভার তিন দিন পর প্রমথরঞ্জন ঠাকুর, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল প্রমুখ নেতা কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতা করার নীতি নেন। তাঁরা ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিডিউলড কাস্ট পার্টি (Independent Scheduled Caste Party) প্রতিষ্ঠা করেন। ঠিক হয়, এই দল কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতা করে চলবে। গান্ধিজিও নমঃশূদ্র নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। তবে সব নমঃশূদ্র নেতাই কংগ্রেসের সঙ্গে এক হওয়ার নীতি মেনে নেননি।

মূল্যায়ন

নমঃশূদ্র আন্দোলন দলিত আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও তা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়। নমঃশূদ্ররা তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য তাদের আন্দোলনকে কখনও জাতিভিত্তিক, কখনও সাম্প্রদায়িক, আবার কখনও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথে পরিচালিত করেছিল।

Leave a Comment