বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ আলোচনা করো
বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ আলোচনা করো |
আধুনিক যুগে উত্তরণের একটি উপাদান হল আধুনিক শিক্ষা আর আধুনিক শিক্ষার অন্যতম প্রধান উপাদান হল ছাপাখানা। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে বাংলায় ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা হয় এবং উনিশ শতকে বাংলায় বিভিন্নভাবে এই ছাপাখানার বিকাশ ঘটে।
বাংলায় প্রথম ছাপাখানার সূচনা
কলকাতায় প্রথম ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা করেন জেমস অগাস্টাস হিকি। প্রথমদিকে হিকির ছাপাখানা থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাপা হত। এই ছাপাখানা থেকে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ‘বেঙ্গল গেজেট’ (Bengal Gazatte) প্রকাশিত হয়। এটি হিকির গেজেট নামেও পরিচিত। এটি হল ভারতে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র।”
প্রথম চলনশীল বাংলা হরফ
প্রারম্ভিক পর্বের বাংলা ছাপাখানার জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন চার্লস উইলকিনস””। তাঁর নাম বাংলা চলনশীল বা মুভেবল টাইপ বা সচল হরফের আবিষ্কর্তা হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছে। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা চার্লস উইলকিনস*** চুঁচুড়াতে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা ভাষায় তাঁর যথেষ্ট পান্ডিত্য ছিল। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের নির্দেশে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের ‘এ গ্রামার অফ দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ (A Grammar Of The Bengal Language) ছাপানোর জন্য তিনি বাংলা হরফ প্রস্তুত করেন। বাংলা হরফ প্রস্তুত করতে তাঁকে সাহায্য করেন পঞ্চানন কর্মকার। এই বাংলা হরফের আবিষ্কার বাংলার ছাপাখানার জগতে এক নবজাগরণের সূচনা করে।
উনিশ শতকে বাংলা ছাপাখানার বিকাশ
উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক বাংলা ছাপাখানা ও বাংলা বই-এর ক্ষেত্রে স্মরণীয় সময়। এই দশকে শ্রীরামপুর ও কলকাতায় কয়েকটি বিখ্যাত ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রীরামপুর ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হয় মাসিক বাংলা পত্রিকা ‘দিগদর্শন’ ও সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা ‘সমাচার দর্পণ’।
বাংলার ছাপাখানার জগতে জোয়ার
বাংলা ছাপাখানার জগতে জোয়ার আসে উনিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে। কারণ–
[1] সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র প্রকাশ: এই সময় থেকে সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের প্রকাশনা বৃদ্ধি পায়। এই পত্রপত্রিকা প্রকাশের জন্য কয়েকটি ছাপাখানা স্থাপিত হয়।
[2] বই প্রকাশ: স্কুল পাঠ্যবই-এর ক্রমবর্ধমান চাহিদা ছাপাখানা স্থাপনে বিশেষভাবে উৎসাহ দিয়েছিল।
ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছাপাখানার বিকাশ
ছাপাখানার বিকাশে ব্যক্তিগত উদ্যোগের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। অনেকে জাতীয়তাবাদী আদর্শে, আবার অনেকে ব্যাবসায়িক উদ্যোগে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যক্তিগত ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও তাঁর ইউ রায় অ্যান্ড সন্স-এর অবদান উল্লেখযোগ্য। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছাপাখানার বিকাশে প্রসেস ও হাফটোন, ব্লক প্রিন্টিং প্রভৃতি বিষয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। রঙিন মুদ্রণের ক্ষেত্রে ডায়াফর্ম যন্ত্র, স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র ইত্যাদি আবিষ্কারের মাধ্যমে মুদ্রণশিল্পে যে গুণগত মানের পরিবর্তন এনেছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
ছাপাখানার ব্যবসায় মধ্যবিত্তশ্রেণির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা
বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার মূল উদ্যোক্তা ছিল ব্রিটিশ আমলে গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। প্রথমপর্বে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠায় ধনী জমিদাররা পৃষ্ঠপোষকতা করলেও কালের ছন্দে মধ্যবিত্তশ্রেণি নিজেদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল।
যৌথ উদ্যোগে বাংলা ছাপাখানার বিকাশ
সমষ্টিগত বা যৌথ উদ্যোগেও বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ ঘটেছিল।
[1] ব্যাপকভাবে ধর্মীয় মতামত প্রকাশ ও প্রসারের জন্য ছাপাখানা স্থাপন করা হয়েছিল। উনিশ শতকে বিভিন্ন মিশনারি সংস্থা ধর্মপ্রচারের জন্য ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিল।
[2] বিভিন্ন কারণে প্রতিষ্ঠিত সভাসমিতি তাদের মতপ্রকাশের ও প্রচারের জন্য ছাপাখানা স্থাপন করেছিল। অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রথমদিকে ছাপাখানা না থাকলেও পরবর্তীকালে তারা ছাপাখানা স্থাপন করেছিল।
[3] পত্রপত্রিকা প্রকাশের জন্য যৌথ উদ্যোগে ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
উপসংহার
বাংলার ছাপাখানার বিকাশে শিল্পবিস্তারের আদর্শ ও ব্যাবসায়িক উদ্যোগ দুই-ই ছিল। ব্রিটিশ আমলে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের ফলে পাঠ্যবই রচনাকে কেন্দ্র করে ছাপাখানার ব্যাপক বিস্তার ঘটে।
FAQs বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ আলোচনা করো
ছাপাখানা প্রথম কে আবিষ্কার করেন?
জোহানেস গুটেনবার্গ।
কলকাতায় কে প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন?
জেমস অগাস্টাস হিকি।
বাংলায় প্রথম ছাপাখানা গড়ে তোলেন কে?
বাংলায় প্রথম ছাপাখানা কোথায় প্রতিষ্ঠিত হয়?
হুগলিতে সর্বপ্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়।