বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট এর ভূমিকা |
ভূমিকা
বাংলাদেশে ইংরেজ শাসন ও পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। পাশ্চাত্য শিক্ষার সূত্র ধরে এদেশে পেশাগত শিক্ষার জন্য কারিগরি শিক্ষার প্রবর্তন হয়। কিছু সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠে। বিভিন্ন শিল্পকারখানা গড়ে উঠলে কারিগরি শিক্ষার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা হয়। এক্ষেত্রে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (Bengal Technical Institute) বা BTI-এর প্রতিষ্ঠা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ প্রতিষ্ঠা
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময়ে গঠনমূলক স্বদেশি বা আত্মশক্তি পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। এই সময় ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে এক জাতীয়তাবাদী শিক্ষাব্যবস্থার পরিকল্পনা করা হয়। এই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১ জুন জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়।
বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর প্রতিষ্ঠা
রাসবিহারী ঘোষ জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সভাপতি এবং আশুতোষ চৌধুরী ও হীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর যুগ্ম সহসভাপতি হন। শুরুতে এই পরিষদ দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গঠন করে- ① সাধারণ বিজ্ঞান এবং কলাবিদ্যার জন্য বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ (Bengal National College) এবং ② কারিগরি শিক্ষার জন্য বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (Bengal Technical Institute)। পরিষদের অন্যতম শিক্ষক বিনয়কুমার সরকার এটিকে পুরোদস্তুর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চালানোর পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি নিম্নতম প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে একেবারে স্নাতকোত্তর অবধি সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষাপ্রদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, যদিও তা অনুমোদিত হয়নি। এইভাবে সোসাইটি ফর দ্য প্রোমোশন অফ টেকনিক্যাল এডুকেশন (Society for the Promotion of Technical Education বা SPTE)-এর উদ্যোগে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুলাই ৯২, আপার সার্কুলার রোডে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (BTI) প্রতিষ্ঠিত হয়।
বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর পাঠক্রম
BTI-এর প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন প্রমথনাথ বসু। প্রথমদিকে এখানে দু-ধরনের পাঠক্রম চালু হয়- তিন বছরের অন্তর্বর্তী পাঠক্রম এবং ② চার বছরের মাধ্যমিক পাঠক্রম। অন্তর্বর্তী পাঠক্রমের তিনটি বিষয় ছিল-① যন্ত্রবিজ্ঞান ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রবিজ্ঞান, ② ফলিত রসায়ন এবং ③ ভূবিদ্যা। এই পাঠক্রমের প্রথম বর্ষে পদার্থবিদ্যা, গণিত, ইংরেজি ও চিত্রাঙ্কন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হত।
বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর শিক্ষকমণ্ডলী
এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রমথ দত্ত, শরৎ বসু, প্রফুল্ল মিত্র, ভূপাল সেন, যোগেশ ঘোষ প্রমুখ বেশ কিছু নামি শিক্ষক। এই সংস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে বেশি অনুদান প্রদান করেন তারকনাথ পালিত। তবে এই প্রতিষ্ঠানের কোনো ছাত্রাবাস ছিল না। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ক্রমশ ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে একটি নতুন কার্যনির্বাহক সমিতি গঠন করা হয়। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে রাওলাট সত্যাগ্রহ এবং ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলনের ফলে জাতীয়তাবাদী কর্মসূচির পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে এই প্রতিষ্ঠানের প্রসারের প্রয়োজনীয়তাও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে শিল্পবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার পরিধি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর অগ্রগতি
জাতীয় শিক্ষা পরিষদ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যাকে সময়োপযোগী করে তোলার জন্য এ বিষয়ে সর্বাধুনিক পাঠ্যক্রম গঠনের উপযুক্ত পরিকাঠামো নির্মাণ ও প্রদর্শনীর উদ্যোগ নিয়েছিল। এই একই উদ্দেশ্যে কয়েকজন প্রতিভাবান ছাত্রকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এই সমস্ত ছাত্ররা হার্ভার্ড, ইয়েল এবং মিচিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিল। বঙ্গীয় বিজ্ঞান কলেজ অর্থনৈতিক অভাব ও নানা কারণে বিলুপ্তির পথে চলে গেলেও ‘বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট’ দীর্ঘজীবী হয়। কেন-না যে প্রযুক্তি ও শিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা তৈরি হয়েছিল তা পূরণ করতে পেরেছিল এই প্রতিষ্ঠানটি।
বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর পত্রিকা প্রকাশ
এই কলেজ ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল এবং কেমিক্যাল এই তিনটি বিভাগে পঠনপাঠনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছিল। এই সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য তারা একটি পত্রিকাও প্রকাশ করে, যার নাম জার্নাল অফ দ্য কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (Journal of the College of Engineering and Technology)। এই পত্রিকা ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই প্রকাশিত হয়।
বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর প্রসার
BTI-এর ছাত্রসংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলে। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে যেখানে সংখ্যা ছিল ১২৪ জন, সেখানে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২০ জন। এজন্য কলকাতার পুরসভার কাছ থেকে ৯৯ বছরের লিজে যাদবপুরে ১০০ বিঘা জমি নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি সেখানে স্থানান্তরিত করা হয় ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই প্রতিষ্ঠান থেকে গড়ে প্রায় ১০০ জন সুযোগ্য ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হয়, যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কারিগরি শিক্ষার বিকাশে নিয়োজিত হয়। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে BTI-এর নতুন নাম হয় ‘কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি’ (College of Engineering and Technology)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে এটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত হয়।
মূল্যায়ন
এইভাবে বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষা ও বিজ্ঞান চেতনার প্রসার ঘটে। এক্ষেত্রে উদ্যোগগুলি ছিল সম্পূর্ণরূপে দেশীয়।