বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর বড়োলাট লর্ড কার্জন প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করেন। এই ঘটনার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ আন্দোলন হয়। ইতিহাসে তা স্বদেশি বা বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন নামে পরিচিত। মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক এই আন্দোলনে মধ্যবিত্তশ্রেণি অংশগ্রহণ করে। কৃষকশ্রেণি এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেনি।

কৃষকশ্রেণির ভূমিকা

কৃষকশ্রেণির দুরবস্থা: ইংরেজ শাসন বাংলাদেশে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজদের লক্ষ্য ছিল যত বেশি সম্ভব রাজস্ব আদায় করা। এই রাজস্ব আদায়ের ফলে কৃষকদের উপর প্রবল আর্থিক চাপ পড়ে। তাই এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে উনিশ শতকে মাঝে মাঝে কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। কেন-না শোষণের বিরুদ্ধে এসময় কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। সেই কৃষকরা বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়তা দেখায়নি।

কৃষকশ্রেণির অনীহা: এসময় সমাজে মধ্যবিত্তশ্রেণি ছিল উদীয়মান শ্রেণি। পাশ্চাত্য শিক্ষা লাভ করে এই শ্রেণি সরকারি চাকরি লাভ করে। বিভিন্ন পেশার মানুষ, যেমন- চিকিৎসক, আইনজীবী, শিক্ষক, করণিক সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজদের চালু করা পুঁজিবাদী আর্থিক ব্যবস্থার সুফল এই শ্রেণি ভোগ করত। যেমন- জমিদারি থেকে ব্যাবসাবাণিজ্য করে তাদের অনেকে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণ গরিব কৃষকের সঙ্গে এই শ্রেণির ব্যবধান প্রকট ছিল। গরিব কৃষকদের দুঃখে যেমন এই মধ্যবিত্তরা সমব্যথী বা সহমর্মী ছিল না, তেমনি মধ্যবিত্তশ্রেণির আহূত আন্দোলনে কৃষকশ্রেণির যোগদানের প্রবণতাও ছিল কম।

বঙ্গভঙ্গের ঘটনায় কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীদের মক্কেল কমে যাওয়ায়, সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় এবং কলকাতাবাসী জমিদারদের পূর্ব বাংলার জমি হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় মূলত এই মধ্যবিত্তশ্রেণি আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল।

আঞ্চলিকতা: লর্ড কার্জন পূর্ব বাংলা সফরের সময় বলেছিলেন, পূর্ব বাংলা একটি পৃথক প্রদেশ হিসেবে গঠিত হলে এখানকার মানুষের বিশেষত গরিব কৃষকদের উন্নতি হবে। এ ছাড়া অন্যান্য বিষয়েও, যেমন- পথঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও উন্নতি হবে। এ ছাড়া তিনি ঢাকায় সলিমউল্লাহ-কে একটি মুসলিম প্রদেশ উপহার দেওয়ার কথা বলেন। বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলার মানুষ বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করে, যাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান ও নমঃশূদ্র কৃষক। মুসলমান কৃষকেরা অংশত ধর্মীয় আবেগে, অংশত হিন্দু জমিদারদের অধীনতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করেছিল। অপরদিকে নমঃশূদ্ররা অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে সরকারি সুযোগ পাওয়ার আশায় বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানায়।

নেতৃত্বের ত্রুটি: বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল মধ্যবিত্তশ্রেণির হাতে। বাংলাদেশে অরবিন্দ ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অশ্বিনীকুমার দত্ত ও ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। বোম্বাই-এ তিলক, যোশি, পরাঞ্জপে এবং মাদ্রাজে চিদাম্বরম পিল্লাই, আনন্দ চালু এবং সুব্রহ্মণ্য আয়ার ছিলেন এই আন্দোলনের প্রধান নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। পাঞ্জাবে লালা লাজপত রায়, জয়পাল প্রমুখ নেতারা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।

কৃষক স্বার্থে কর্মসূচির অভাব : এইসব নেতারা তাদের শ্রেণিচরিত্রের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। গণ আন্দোলনে সাধারণ মানুষের যে ভূমিকা থাকতে পারে সে-কথা তারা মনে করতেন না। যদিও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই মনোভাবের ব্যতিক্রমী ছিলেন, তথাপি তাঁর আন্দোলনেও কোনো কৃষককে তিনি শামিল করতে পারেননি। গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে এইসব নেতাদের যোগাযোগ ছিল না। কৃষকদের দুর্দশা দূর করার কথা তারা চিন্তা করতেন না। অধ্যাপক সুমিত সরকার মনে করেন, মধ্যবিত্তশ্রেণির নেতৃত্বে পরিচালিত এই আন্দোলনে কৃষক সম্প্রদায়কে শামিল করানো যায়নি, কারণ ছিল ‘সুনির্দিষ্ট কৃষিভিত্তিক কর্মসূচি’-র অভাব।

সামগ্রিকভাবে কৃষকদের প্রতিক্রিয়া

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ই পূর্ববঙ্গে, বিশেষ করে ময়মনসিংহ, কুমিল্লা প্রভৃতি স্থানে পরপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দিয়েছিল। অন্যদিকে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী এই দাঙ্গার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে স্থানীয় হিন্দু জমিদার ও ইজারাদারদের বয়কটের নামে দরিদ্র মুসলমানদের উপর অত্যাচারকে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু এই দাঙ্গার নেপথ্যে গ্রামবাংলার সম্পত্তি ও কৃষকদের সম্পর্ককে অস্বীকার করা যায় না। কেন-না ময়মনসিংহে প্রতিবাদী জনতার আক্রমণের লক্ষ্য ছিল হিন্দু জমিদার ও মহাজনরা। পূর্ববঙ্গের জমিদাররা অধিকাংশ হিন্দু এবং কৃষকরা বেশিরভাগই মুসলমান হওয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রকট হয়ে উঠেছিল। বোধহয় এইসব কারণেই কংগ্রেসের নেতৃত্বে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বড়ো কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়নি। ঐতিহাসিক সুমিত সরকারের মতে, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে জনবিচ্ছিন্নতা থেকেই ব্যক্তিহত্যার রাজনীতির সূচনা হয়।

মূল্যায়ন

অধ্যাপক সুমিত সরকারের মতে, স্বদেশি আন্দোলনের নেতারা খাজনা বন্ধের মতো কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেননি। কারণ- এই আন্দোলনের নেতারা জমিদারদের অর্থের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। অমলেশ ত্রিপাঠীও এই মত স্বীকার করেছেন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকায় কৃষকদের ক্ষোভ সংক্রান্ত এক দীর্ঘ চিঠি প্রকাশিত হলেও আন্দোলনের নেতাদের তা প্রভাবিত করেনি। তাই কৃষকেরা স্বাভাবিকভাবে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি।

Leave a Comment