ফরাসি সংবিধান সভার কার্যাবলির সমালোচনামূলক মূল্যায়ন করো। |
‘টেনিস কোর্ট-এর শপথ’-এর মাধ্যমে গড়ে ওঠা জাতীয় সভা ফ্রান্সের জন্য সংবিধান রচনায় উদ্যোগী হলে পরবর্তীকালে তা সংবিধান সভায় পরিণত হয় (৯ জুলাই, ১৭৮৯ খ্রি.)। দু’বছরের প্রচেষ্টায় এই সভা ফ্রান্সের জন্য একটি সংবিধান রচনা করে। ফরাসি সংবিধান সভা ফ্রান্সের প্রশাসনিক, সাংবিধানিক, আর্থসামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করেছিল।
সংবিধান সভার কার্যাবলির সমালোচনা
ফরাসি সংবিধান- সভার কার্যাবলির মধ্যে বেশ কিছু ত্রুটি ছিল, যেমন-
দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থার অভাব
নতুন সংবিধান অনুযায়ী রাজার সার্বভৌম ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হওয়ায় কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। এ ছাড়া, মন্ত্রীরা আইন পরিষদের কাছে দায়বদ্ধ না হওয়ার ফলে আইন পরিষদের সঙ্গে রাজা ও মন্ত্রীমণ্ডলীর মধ্যে কোনো যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। ফলে ফ্রান্সে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়নি।
সীমিত ভোটাধিকার
ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে জনগণকে ‘সক্রিয়’ ও ‘নিষ্ক্রিয়’ নাগরিকরূপে ভাগ করার ফলে নিম্নবিত্ত শ্রেণির জনসাধারণের অনেকেই ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এই ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী ছিল।
যাজক অসন্তোষ
চার্চ-সংক্রান্ত বিধানের ফলে চার্চের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হওয়ায় যাজক সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। যদিও নিম্নশ্রেণির যাজকরা প্রথমে বিপ্লবের পক্ষে ছিলেন, কিন্তু নতুন বিধানের ফলে তারা ক্ষুব্ধ হন এবং বিপ্লব-বিরোধী হয়ে পড়েন।
বুর্জোয়া স্বার্থরক্ষা
সংবিধান সভা ফ্রান্সের সব শ্রেণির জনগণের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষায় সুষ্ঠু ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, কারণ সংবিধান রচয়িতারা শিক্ষিত ও উচ্চমধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষায় অধিকতর আগ্রহী ছিলেন। সংবিধান সভায় কার্যকলাপ পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন অ্যাবে সিয়েস, লাফায়েৎ, মিরাবো প্রমুখ।
পরস্পর বিরোধী
শাসনব্যবস্থায় বিকেন্দ্রীকরণ নীতি প্রশাসনিক শ্লথতা এনেছিল। সংবিধান সভার সদস্যদের আইন প্রণয়নের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। স্বভাবতই তাঁদের ক্রিয়াকলাপ অসংলগ্ন ও পরস্পর বিরোধী হয়ে উঠেছিল।
সংবিধান সভার ইতিবাচক দিক
উপরোক্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও ফরাসি সংবিধানসভার কার্যাবলিকে একেবারে উপেক্ষা করা যায় না, কারণ :
নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র
ফ্রান্সের প্রচলিত সামন্ততান্ত্রিক ও স্বৈরতন্ত্রী ব্যবস্থার ওপর ফরাসি সংবিধান সভা ব্যাপক আঘাত হেনেছিল।
সামন্ততন্ত্রের উচ্ছেদ
সংবিধান সভা সামন্ততন্ত্রের উচ্ছেদ করে ফ্রান্সে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রবর্তিত করেছিল।
গণসার্বভৌমত্ব
জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
জনকল্যাণ
গরিবের ত্রাণকে (relief for the poor) রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য বলে গৃহীত হয়েছিল।
বিচারব্যবস্থা
বিচারব্যবস্থায় সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
মূল্যায়ন
সংবিধান সভার কার্যাবলি ছিল ফ্রান্সের পুরানো ব্যবস্থার “মৃত্যু পরোয়ানা” (death-warrant)। অন্যদিকে ঐতিহাসিক মাদেলাঁ-র মতে, “সংবিধান সভার ব্যাপক সংস্কারকার্য ইতিহাসে অনন্য হলেও তা ছিল জীর্ণ ও ভঙ্গুর” (“The huge work of reform unique in history, was very poor and fragile in construction”)।