ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান মূল্যায়ন করো |
ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত প্রচলিত আছে। ফরাসি ঐতিহাসিক আবে বারওয়েল ও ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ এডমন্ড বার্ক মনে করেন যে, ফরাসি বিপ্লবের প্রধান কারণ হল দার্শনিকদের ষড়যন্ত্র। অপরদিকে অর্থনীতিবাদী ঐতিহাসিক যথা-লেফেভর, স্টিফেন্স প্রমুখরা ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। সেক্ষেত্রে দার্শনিকদের ভূমিকা ছিল গৌণ।
দার্শনিকদের ভূমিকার পক্ষে যুক্তি
হল্যান্ড রোজ, রাইকার, তেইন, বুস্তাঁ, সেতোব্রিয়াঁ, মাদেলাঁ, জোরেস, মাতিয়ে, গোদখো, লাব্লুস, মর্জে প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ দার্শনিকদের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তেইনের মতে, “France drank the poison of Philosophy”। নিম্নলিখিতভাবে তাঁরা তাদের মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন।
বিপ্লবী মানসিকতা তৈরি
কোনো সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে লোকের অসন্তোষ থাকলেই কেবলমাত্র তার জন্য বিপ্লব হয় না। অসন্তুষ্ট শ্রেণিকে যদি প্রচলিত ব্যবস্থার দোষত্রুটি দেখিয়ে সেই ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীন করা না যায়, তবে লোকে সেই ব্যবস্থা ভাঙার জন্য বিপ্লব করে না। ফ্রান্সের দার্শনিকেরা সরাসরি বিপ্লবের কথা না বললেও তাঁরা প্রচলিত ব্যবস্থার সমালোচনা করে একটি বিপ্লবী মানসিকতা (Revolutionary Psychology) গড়ে তোলেন।
জনমত গঠন
ফ্রান্সের শিক্ষিত মানুষ দার্শনিকদের মতামতের কথা মোটামুটি জানত। প্যারিসের চা-দোকান ও ক্লাবগুলিতে দার্শনিকদের মতামত আলোচিত হত। এই সকল স্থান থেকে সাধারণ লোক যারা পড়াশোনা জানত না তারা দার্শনিকদের ভাবধারা সম্পর্কে অবহিত হত। গ্রামের নিম্নবর্গের যাজকেরা তাদের গির্জার ভাষণে দার্শনিকদের মতামত প্রচার করত। ফলে জনমত গঠনে দার্শনিকদের একটা মস্ত বড়ো অবদান ছিল।
মৌলিক চিন্তা
দার্শনিকদের প্রত্যেকে মৌলিক চিন্তার ও মতবাদের প্রবর্তক। সুতরাং তাঁরা একমত হবেন না-এটাই ছিল স্বাভাবিক। তবে প্রাক্-বিপ্লব যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে মতভেদ ছিল না। এঁদের দর্শনের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বৈপ্লবিক। ‘দার্শনিকরা যে বীজ বপন করেন তা উপযুক্ত জমিতেই অঙ্কুরিত হয়’।
দার্শনিকদের ভূমিকার বিপক্ষে যুক্তি
লেফেভর, মনিয়র, সোর্থ স্টিফেন্স, ম্যালে দা পান প্রমুখ অর্থনীতিবাদী ঐতিহাসিকদের মতে, তদানীন্তন সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যই ছিল বিপ্লবের মূল কারণ; দার্শনিকদের ভূমিকা ছিল নগণ্য। ম্যালে দ্য পান বলেন যে, দার্শনিকেরা পুরাতন ব্যবস্থার সমালোচনা করলেও তার জন্যে লোকে বিদ্রোহী হয় এ কথা মনে করার কারণ নেই। এঁরা নিম্নলিখিতভাবে তাঁদের যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন।
বাস্তব অবস্থার প্রতিক্রিয়া
ফ্রান্সের সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক জীবনে যদি অন্যায় ও বৈষম্য না থাকত তবে বিপ্লব আদপেই ঘটত না। কাজেই বিপ্লব ছিল বাস্তব অবস্থার প্রতিক্রিয়া। এক্ষেত্রে দার্শনিকদের প্রভাব ছিল গৌণ।
প্রত্যক্ষ যোগাযোগের অভাব
দার্শনিকেরা প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাঁরা বিপ্লবের কথা বলেন নি। তাঁরা পুরাতনতন্ত্রের দোষত্রুটির কথা বললেও তা ভেঙে ফেলার ডাক দেননি বা প্রতিকারের পথ দেখাননি।
গণশিক্ষার অভাব
প্রাক্-বিপ্লব যুগে ফ্রান্সে গণশিক্ষা ছিল না। সমাজের বেশির ভাগ লোক ছিল অশিক্ষিত। তারা দার্শনিকদের রচনা পড়তে পারত না বা দার্শনিকদের মতবাদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। স্বাভাবিক কারণেই বলা যেতে পারে সাধারণ লোকের ওপর দার্শনিকদের বিশেষ প্রভাব ছিল না।
দার্শনিকদের মধ্যে মতানৈক্য
দার্শনিকদের মধ্যে ঐক্যমত ছিল না। রুশো প্রজাতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাস করতেন, মন্তেস্কু ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের অনুরাগী। ভলতেয়ার, রুশো বা মন্তেস্কর মতো মৌলিক চিন্তার অধিকারী ছিলেন না। ফিজিওক্র্যাটরা কেবল অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা ভাবতেন। দার্শনিকদের মধ্যে ঐক্যমত না থাকায় জনসাধারণ বিভ্রান্ত হত এবং প্রভাবিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
পরিশেষে বলা যায় যে, ফরাসি বিপ্লব ঘটার পেছনে দার্শনিকদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না। বিপ্লবের সঙ্গে সম্পর্কহীন এই দার্শনিকেরা বিপ্লবকালে কেউই জীবিত ছিলেন না। এই কারণে ডেভিড টমসন যথার্থই মন্তব্য করেছেন, দার্শনিকদের সাথে ফরাসি বিপ্লবের যোগ ছিল কিছুটা দূরবর্তী (Remote) – এবং পরোক্ষ (Indirect), প্রকৃতপক্ষে তদানীন্তন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাই বিপ্লবের পটভূমি রচনা করেছিল।