ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের সামাজিক অবস্থা কীরূপ ছিল বর্ণনা করো |
ভূমিকা :
ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফরাসি সমাজ মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় গঠিত তিনটি এস্টেটে বিভক্ত ছিল। যাজক ও অভিজাত শ্রেণি ছিল যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় এস্টেট এবং অধিকারপ্রাপ্ত শ্রেণি। প্রথম ও দ্বিতীয় এস্টেট বাদে সমাজের বাকি সকলকে নিয়ে গঠিত ছিল তৃতীয় এস্টেট বা অধিকারহীন শ্রেণি।
যাজক বা প্রথম সম্প্রদায়:
ফরাসি বিপ্লবের পূর্বেফ্রান্সের প্রথম সম্প্রদায়ভুক্ত যাজকের সংখ্যা ছিল প্রায় 1 লক্ষ 20 হাজার। এদের কাজ ছিল ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ পালন করা। ক্যাথলিক চার্চের আইনকানুন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যাজকদের ওপর রাজার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ফ্রান্সের সমগ্র জনসংখ্যার 1 শতাংশ না হয়েও তারা রাজনৈতিক, রাজস্ব ও বিচার সংক্রান্ত বিশেষ সুযোগসুবিধা ভোগ করতেন। যাজকদের আর্থিক ক্ষমতার উৎস ছিল টাইথ নামক ধর্মকর এবং স্থাবর সম্পত্তি। বিপুল সম্পদের অধিকারী যাজকরা রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহের জন্য স্বেচ্ছাদান এবং দেসিম নামক কর ছাড়া আর কিছুই দিতেন না। যাজক সম্প্রদায় দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল উচ্চ যাজক এবং নিম্ন যাজক। উচ্চ যাজকদের মধ্যে ছিলেন বিশপ, ক্যানন, মঠাধ্যক্ষ প্রমুখ। দরিদ্র ও নিষ্ঠাবান নিম্ন যাজকদের দিন কাটত অপরিসীম আর্থিক দুর্দশায়। স্বাভাবিকভাবেই নিম্ন যাজকদের মধ্যে বিদ্বেষভাব ছিল। তাঁরা ফরাসি দার্শনিকদের রচনার সংস্পর্শে এসে সামাজিক বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন এবং বিপ্লবের সময় নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তৃতীয় এস্টেটের সঙ্গে যোগ দেন।
অভিজাত বা দ্বিতীয় সম্প্রদায়:
ফরাসি সমাজের অপর সুবিধাভোগী শ্রেণি ছিল অভিজাত সম্প্রদায়। এরা ছিল মূলত ভূস্বামী এবং সরকার ও প্রশাসনের উচ্চ পদাধিকারী গণ্যমান্য ব্যক্তি। 1789 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে এদের সংখ্যা ছিল প্রায় 3 লক্ষ 50 হাজার অর্থাৎ, জনসংখ্যার প্রায় দেড় শতাংশ। প্রত্যেক অভিজাতই মর্যাদাপূর্ণ আর্থিক ও রাজপদ সংক্রান্ত সুযোগসুবিধা ভোগ করতেন। বিপ্লবের পূর্বে মোট আবাদি জমির এক-পঞ্চমাংশ ছিল অভিজাতদের দখলে। যাজকদের মতো তাঁরাও বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল, যেমন-① দরবারি অভিজাত, ② গ্রামীণ ভূস্বামী, সম্পদশালী উচ্চপদস্থ বুর্জোয়া।
① দরবারি অভিজাত : অভিজাতদের মধ্যে উচ্চতর ছিল দরবারি অভিজাত। রাজানুরক্ত এই গোষ্ঠী ভার্সাই নগরে বাস করত এবং অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপন করত। এরা নিজেদের বংশকৌলিন্য নিয়ে গর্বিত ছিল। বিপ্লবের পূর্বে দরবারি অভিজাতদের সংখ্যা ছিল প্রায় চার হাজার অর্থাৎ, মোট অভিজাতদের এক-তৃতীয়াংশ।
② গ্রামীণ ভূস্বামী: অভিজাতদের একটি গোষ্ঠী ছিল গ্রামীণ ভূস্বামী। কৃষকদের কাছ থেকে আদায়িকৃত সামন্ত কর ছিল এদের আয়ের একমাত্র উৎস।
③ সম্পদশালী উচ্চপদস্থ বুর্জোয়া: অভিজাতদের মধ্যে অপর একটি গোষ্ঠী ছিল যাদের বংশকৌলিন্য ছিল না। এরা অর্থের বিনিময়ে রাজার কাছ থেকে অভিজাত পদ ক্রয় করে অভিজাত সম্প্রদায়ভুক্ত হত।
তৃতীয় সম্প্রদায়:
মোট জনসংখ্যার 97% ছিল তৃতীয় সম্প্রদায়ের মানুষ। তৃতীয় সম্প্রদায়কে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়- বুর্জোয়া, ② কৃষক এবং ③ সাঁকুলোৎ।
① বুর্জোয়া : অভিজাত সম্প্রদায়ভুক্ত না হয়েও যারা জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপন করত তারাই বুর্জোয়া নামে পরিচিত। আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী বুর্জোয়ারা তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল- (i) উচ্চ বুর্জোয়া-মূলত ধনী শিল্পপতি, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী; (ii) মধ্য বুর্জোয়া-সাহিত্যিক, দার্শনিক, আইনজীবী, অধ্যাপক, চিকিৎসক প্রমুখ। (iii) নিম্ন বুর্জোয়া-ঠিকাদার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দোকানদার প্রমুখ। শিক্ষা এবং অর্থ দুটি দিক থেকেই এরা উচ্চ ও মধ্য বুর্জোয়াদের থেকে পিছিয়েছিল।
② কৃষক: মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক ফরাসি সমাজে বিভিন্নভাবে অত্যাচারের শিকার হত কৃষকরা। বিভিন্ন কর ছাড়াও কৃষকরা বাধ্যতামূলক শ্রমদান বা করভি দিতে বাধ্য ছিল। আর্থিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে | হতদরিদ্র অবস্থা ছিল ভূমিহীন কৃষক এবং ভাগচাষিদের।
③ সাঁকুলোৎ : হতদরিদ্র সাঁকুলোত্রাও ছিল তৃতীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। কারখানার শ্রমিক, রাজমিস্ত্রি, কাঠুরে, কারিগর, মালি, জেলে, ভৃত্য প্রমুখ মেহনতি মানুষদের সাঁকুলোৎ বলা হত।
মূল্যায়ন:
বহু ঐতিহাসিকের মতে ফরাসি বিপ্লবের মূল কারণ ছিল-সামাজিক বৈষম্য। গুডউইন মনে করেন, অভিজাতদের প্রতিক্রিয়াশীল আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ফরাসি বিপ্লবের কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। যাজক ও অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য, বুর্জোয়াদের সামাজিক ও রাজনৈতিক মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষা এবং সামন্ততান্ত্রিক শোষণ থেকে কৃষকদের মুক্তি লাভের প্রচেষ্টা বিপ্লব ডেকে এনেছিল। নেপোলিয়ান বোনাপার্টের ভাষায় ফরাসি বিপ্লব ছিল সুবিধাভোগী শ্রেণির বিরুদ্ধে সুবিধাহীন শ্রেণির সাধারণ গণ আন্দোলন।