ফরাজি আন্দোলনের উপর একটি নিবন্ধ লেখো

ফরাজি আন্দোলনের উপর একটি নিবন্ধ লেখো
ফরাজি আন্দোলনের উপর একটি নিবন্ধ লেখো।

ফরাজি আন্দোলন

বাংলার কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে যেসকল বিদ্রোহ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম হল ফরাজি আন্দোলন। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই আন্দোলন চলেছিল।

প্রতিষ্ঠাতা

ফরাজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হাজি শরিয়ৎউল্লাহ। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের অন্তর্গত ফরিদপুর জেলার বাহাদুরপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কোরান ও ইসলামি ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে শিক্ষালাভ করার উদ্দেশ্যে তিনি মক্কায় যান এবং সেখানে ওয়াহাবি আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হন। প্রায় ২০ বছর বিদেশে থেকে ইসলামীয় ধর্মতত্ত্বে পাণ্ডিত্য অর্জন করে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফরাজি নামে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন এবং ধর্মসংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

আদর্শ ও লক্ষ্য

‘ফরাজি’ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য। শরিয়ৎউল্লাহ ঘোষণা করেন যে, ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরে ইসলামবিরোধী নানা কুসংস্কার ও দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সে কারণে তিনি কোরানের নির্দেশ পালন করে ইসলাম ধর্মের সংস্কারসাধনের কথা বলেন। ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও অচিরেই এই আন্দোলন রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। তিনি ঘোষণা করেন, ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারতবর্ষ দার-উল- হারব বা শত্রুর দেশে পরিণত হয়েছে। তাঁর মতে, এই দেশ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বাসযোগ্য নয়। শুদ্ধ ইসলামিক রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি সকলকে আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল, ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মুসলিম চাষি, কারিগর ও তাঁতি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি তাঁর শিষ্যদের জমিদার ও নীলকরদের শোষণের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টাও করেছিলেন।

দুদু মিঞা ও ফরাজি আন্দোলন

শরিয়ৎউল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মহম্মদ মহসিন ওরফে দুদু মিঞা আন্দোলনের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল জমিদারি শাসন ও বিদেশি ইংরেজ শাসনের উচ্ছেদ করে স্বাধীন মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ঘোষণা করেন, সকল মানুষই সমান, আল্লাহর সৃষ্ট পৃথিবীতে কর ধার্যের অধিকার কারও নেই। তাঁর নির্দেশে মুসলমান প্রজারা জমিদারদের কর দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল।

ফরাজি আন্দোলনের বিস্তার

দুদু মিঞার নেতৃত্বে এই আন্দোলন ফরিদপুর ও ঢাকা থেকে বাখরগঞ্জ, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোহর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার ব্যাপক অঞ্চলে বিস্তৃত হয়।

জমিদার, নীলকর ও ইংরেজ সরকারের সঙ্গে বিরোধ

দুদু মিঞার কার্যকলাপে বিরক্ত হয়ে জমিদার, নীলকর ও ইংরেজ সরকার জোটবদ্ধ হয়। তারা একাধিকবার দুদু মিঞাকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে শেষবার তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। দীর্ঘ কারাবাসের ফলে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে। অবশেষে নানাপ্রকার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।

ফরাজি আন্দোলনের গুরুত্ব

ফরাজি আন্দোলন তার লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ হলেও একেবারে গুরুত্বহীন ছিল না। জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে নিপীড়িত কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে এবং তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা প্রচার করে দুদু মিঞা কৃষকদের নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ ছাড়া ফরাজি আন্দোলনে বাংলার কৃষকসমাজে এক সংগ্রামী ঐতিহ্য রেখে গিয়েছে। ফরাজি আন্দোলনে তাদের জোটবদ্ধতার ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পরবর্তীকালে পাবনার কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে যার প্রতিফলন পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

Leave a Comment