প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮ খ্রি.) পরবর্তীকালে ভারতে কৃষক আন্দোলনগুলির পরিচয় দাও

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮ খ্রি.) পরবর্তীকালে ভারতে কৃষক আন্দোলনগুলির পরিচয় দাও
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮ খ্রি.) পরবর্তীকালে ভারতে কৃষক আন্দোলনগুলির পরিচয় দাও।

ভূমিকা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারায় অংশগ্রহণ করার পাশাপাশি নিজেদের স্বার্থরক্ষার তাগিদে পৃথকভাবে গড়ে ওঠা কৃষক আন্দোলনেও শামিল হয়েছিল অসংখ্য কৃষক। এইসব কৃষক আন্দোলনগুলি কৃষকদের স্বার্থরক্ষার পাশাপাশি জাতীয় আন্দোলনকেও শক্তিমালী করেছিল।

ভারতের বিভিন্ন স্থানের কৃষক আন্দোলনের পরিচয়

বাংলা কৃষক আন্দোলন

১৯২০-২১ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাংলার মেদিনীপুরের তমলুক ও কাঁথি মহকুমায় বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে কৃষকরা ইউনিয়ন বোর্ড বয়কট করে। এ ছাড়াও তারা চৌকিদারি কর দেওয়া বন্ধ করে দেয়। পাবনা, বগুড়া, বীরভূমে জমি জরিপ করে খাজনা নির্ধারণের কাজে স্থানীয় কৃষকরা বাধা দেয়। কুমিল্লা, রাজশাহি, রংপুর, দিনাজপুরে কৃষকরা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়।

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই থেকে বাঁকুড়া জেলায় খাজনা বন্ধের আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। বাংলার কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল বেঙ্গল ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি এবং ফজলুল হক ও আক্রম খাঁ-এর উদ্যোগে গঠিত কৃষক প্রজা পার্টি।জানাকী হচ্ছেন

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় বাংলার মেদিনীপুরের কৃষকরা জমিদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর তমলুকে আন্দোলনকারীরা একটি সমান্তরাল সরকার গড়ে তোলে। এর নাম হয় তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার।

বিহারে কৃষক আন্দোলন

বিহারেও একের পর এক কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। স্বামী বিদ্যানন্দের নেতৃত্বে দ্বারভাঙা, মুজফ্ফরপুর, ভাগলপুর, পূর্ণিয়া, মুঙ্গেরের কৃষকরা কর দেওয়া বন্ধ করে। বিহার কিষান সভা ও সারা ভারত কিষান সভার প্রতিষ্ঠাতা স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী বিহারে বেশ কিছু কৃষক সংগঠন গড়ে তোলেন। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৩৮-৩৯ খ্রিস্টাব্দে ‘বখস্ত ভূমি আন্দোলন’ তীব্রতর হয়। আগস্ট আন্দোলনের সময় মধুবনি অঞ্চলে প্রায় ৫০০০ জনতা সশস্ত্র অবস্থায় থানা আক্রমণ করে। এদের মধ্যে সিংহভাগই ছিল কৃষক।

যুক্তপ্রদেশে কৃষক আন্দোলন

যুক্তপ্রদেশে বাবা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে প্রতাপগড়, রায়বেরিলি, সুলতানপুর ও ফৈজাবাদের কৃষকরা জমিদারদের বিরুদ্ধে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে (১৯২০ খ্রি.)। এই কৃষকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে জওহরলাল নেহরু গঠন করেন যুক্তপ্রদেশ কিষান সভা।

একা আন্দোলন

১৯২১ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে যুক্তপ্রদেশের সীতাপুর, বরাইচ, হরদই, বারাবাঁকি প্রভৃতি জেলায় কৃষক আন্দোলনের সূচনা হয়। যুক্তপ্রদেশে ছিল তালুকদারদের প্রাধান্য। তারা যেমন খুশি খাজনা আদায় করত। জমি থেকে চাষিদের যখন খুশি উচ্ছেদ করত। এর প্রতিবাদেই কংগ্রেস ও কিষানসভার কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে এই আন্দোলন করে। এই ঐক্য বা একতা থেকেই আন্দোলনটি একা আন্দোলন নামে পরিচিত হয়। খিলাফতি নেতারাও এই আন্দোলনকে সমর্থন করেন। শুরুতে অবশ্য কংগ্রেসি ও খিলাফতি নেতারাই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ক্রমশ আন্দোলন হিংসাত্মক রূপ গ্রহণ করলে তারা আন্দোলন থেকে সরে আসেন। অতঃপর এই আন্দোলনে মাদারি পাসির নেতৃত্বে কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ নেয়। কিন্তু হিংসাত্মক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশি অত্যাচারে এই আন্দোলন ভেঙে যায়। ঐতিহাসিক হবসবম এই আন্দোলনের হিংসাত্মক রূপকে সামাজিক দস্যুতা (Social banditry) বলে চিহ্নিত করেছেন।

মালাবার – মোপালা বিদ্রোহ

অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন মালাবার অঞ্চলে যে কৃষক বিদ্রোহ ঘটে, তার নাম মোপালা বিদ্রোহ। অস্পষ্ট প্রজাস্বত্ব আইন এবং জমিদারদের তীব্র শোষণের বিরুদ্ধে মোপালারা কৃষক বিদ্রোহ গড়ে তোলে। মালাবারের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক কৃষক সংগঠন গড়ে ওঠে। এই সংগঠনগুলির নেতৃত্বে মোপালা কৃষক বিদ্রোহ সুসংহত ও তীব্র রূপ ধারণ করে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে মোপালা নেতা ইয়াকুব হাসান গ্রেফতার হলে মোপালাদের মধ্যে যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয় তার ফলে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরালো হয়ে ওঠে। তারা সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করে, এমনকি পুলিশচৌকি আক্রমণ করে। সরকারি রিপোর্ট অনুসারে প্রায় ১০ হাজার মোপালা গেরিলা যুদ্ধের কৌশলে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালায়। শেষের দিকে এই বিদ্রোহ সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়। শেষপর্যন্ত সামরিক আইন জারি করে সরকার এই আন্দোলনের অবসান ঘটায়।

অন্ধ্রপ্রদেশ – রাম্পা বিদ্রোহ

অসহযোগ আন্দোলনের সময় অন্ধ্রপ্রদেশের কৃয়া, গুন্টুর ও গোদাবরী জেলার কৃষক ও আদিবাসীরা আন্দোলন করেছিল। অন্ধ্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কৃষক বিদ্রোহ হল উত্তর গোদাবরী অঞ্চলে আল্লুরি সীতারাম রাজু পরিচালিত রাম্পা বিদ্রোহ (১৯২২-২৪ খ্রি.)। এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী কৃষকরা গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ শুরু করে। মহাজনদের শোষণ ও জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীরা সরব হয়। অরণ্য আইনের মাধ্যমে সরকার তাদের অরণ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে এবং রাস্তা তৈরির কাজে বেগার খাটালে এই বিদ্রোহ ঘটে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে আল্লুরি সীতারাম রাজু ধরা পড়লে রাম্পা বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়।

গুজরাট – বারদৌলি কৃষক সত্যাগ্রহ

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের সুরাট জেলার অন্তর্গত বারদৌলির কৃষকরা জমিদারের অনাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে, যা বারদৌলি সত্যাগ্রহ নামে পরিচিত। এই কৃষক সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব দেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। বারদৌলিতে সরকার শতকরা ৩০ ভাগ রাজস্ব বৃদ্ধির নির্দেশ দিলে সর্দার প্যাটেল হিন্দু কৃষকদের গীতা ও মুসলিম কৃষকদের কোরান ছুঁইয়ে খাজনা না দেওয়ার শপথ গ্রহণ করান। আন্দোলনের তীব্রতায় শেষপর্যন্ত সরকার তদন্ত কমিশন নিয়োগ করে কৃষকদের সঙ্গে মীমাংসায় বসতে বাধ্য হয় এবং বারদৌলি কৃষক আন্দোলন সাফল্য পায়।

মূল্যায়ন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতের বিভিন্ন অংশে গড়ে ওঠা কৃষক আন্দোলনগুলিকে সুসংহত রূপ দেওয়া ও ঐক্যবদ্ধ করে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় একাধিক কিষানসভা। এই লক্ষ্যে কংগ্রেসের সমাজতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্টরা মিলে প্রতিষ্ঠা করে সারা ভারত কিষান কংগ্রেস (১৯৩৬ খ্রি.); পরে যার নাম হয় সারা ভারত কিষানসভা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মূলত কৃষক আন্দোলনের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে কংগ্রেস ও বিভিন্ন আঞ্চলিক নেতৃবৃন্দ।

Leave a Comment