পাঞ্জাবে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের বিবরণ দাও। |
ভূমিকা
বাসুদেব বলবন্ত ফাদকে মহারাষ্ট্রে বিপ্লববাদের যে বীজ বপন করেছিলেন, তা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং পল্লবিত হয়ে পাঞ্জাবে শাখা বিস্তার করে। ইংরেজ সরকারের শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের যুবসমাজের একাংশ গুপ্ত সমিতির মাধ্যমে সশস্ত্র বিপ্লবী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়।
সাহারানপুর গুপ্ত সমিতি
১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের সাহারানপুরে প্রবাসী বাঙালি জে এম চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর সহযোগী যুবকেরা একটি গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। পুলিশি সক্রিয়তায় তাদের কার্যকলাপে অসুবিধা হওয়ায় এই সমিতি রুড়কীতে স্থানান্তরিত হয়। রুড়কী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অনেক ছাত্র এই সমিতিতে যোগদান করে। পরে লালা হরদয়াল, অজিত সিংহ, সুফী অম্বাপ্রসাদ এই সমিতিতে যোগদান করেন। এর ফলে সমিতির সদস্যসংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি সমিতির কার্যকলাপ বিস্তৃত হয়। এই সময় থেকেই পাঞ্জাবে বৈপ্লবিক কার্যকলাপ শুরু হয়।
লালা হরদয়াল, অম্বাপ্রসাদ, অজিত সিংহের ভূমিকা
লালা হরদয়াল-এর নেতৃত্বে পাঞ্জাবের বিভিন্ন অঞ্চলে বিপ্লববাদ ছড়িয়ে পড়ে। এইসব অঞ্চলে বিপ্লবী সমিতির বহু শাখা তৈরি হয়। অম্বাপ্রসাদ ও অজিত সিংহ বিপ্লবী মতাদর্শ প্রচারের জন্য ‘ভারতমাতা’ ও ‘বঙ্গের শিয়াল’ নামে রাজদ্রোহমূলক পত্রপত্রিকা প্রকাশ করেন। পাঞ্জাবের যুবসমাজকে ইংরেজ শাসনের বিরোধী করে তোলা তাদের লক্ষ্য ছিল। পাঞ্জাবে বিপ্লববাদে আর্য সমাজের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। অজিত সিংহ এক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মাশ্রয়ী মনোভাব ত্যাগ করে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলেন। এর ফলে আন্দোলনের প্রসার ঘটে কিন্তু পুলিশ তাঁকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে। পুলিশের গ্রেফতারি এড়াতে অজিত সিংহ ভারত ছেড়ে পারস্যে পালিয়ে যান। লালা হরদয়াল এই সময় আবার বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ‘বয়কট’ ও ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’-এর ডাক দেন। পুলিশি ব্যবস্থা এড়াতে তিনিও ভারত ত্যাগ করেন (১৯১০ খ্রি.)। এই সময় রাসবিহারী বসু পাঞ্জাব ও উত্তর ভারতের বিপ্লবীদের সংগঠিত করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
রাসবিহারী বসুর ভূমিকা
রাসবিহারী বসুর প্রধান লক্ষ্য ছিল সেনাবাহিনীর মধ্যে বিপ্লবী মতবাদ প্রচার করে বিদ্রোহের মানসিকতা তৈরি করা। তিনি অনুভব করেছিলেন এইভাবে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ইংরেজদের হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া যাবে। তিনি দিল্লিতে তাঁর কর্মকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি ভারতের নতুন রাজধানী হয়। এই উপলক্ষ্যে বড়োেলাট লর্ড হার্ডিঞ্জ হাতির পিঠে চড়ে রাজপথে শোভাযাত্রায় বের হন। রাসবিহারী বসুর নির্দেশে তাঁর সহযোদ্ধা বসন্ত বিশ্বাস বড়োলাটের উপর বোমা নিক্ষেপ করেন। বড়োলাট প্রাণে বাঁচেন কিন্তু তার ছত্রধর আহত হন (২৩ ডিসেম্বর, ১৯১২ খ্রি.)। এরপর পাঞ্জাবের পুলিশ কমিশনার জর্ডন-কে হত্যার জন্য রাসবিহারী বসুর নির্দেশে লাহোরের এক উদ্যানে বোমা রাখা হয়। বোমা বিস্ফোরণে একজন চাপরাশি মারা যায়। রাসবিহারী বসু আত্মগোপন করেন। পুলিশ আমির চাঁদ, অবোধবিহারী, বসন্ত বিশ্বাস-কে গ্রেফতার করে দিল্লি ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে। বিচারে তাঁদের ফাঁসি হয় (১১ মে, ১৯১৫ খ্রি.)।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তার সুযোগ নিয়ে রাসবিহারী বসু এক ব্যাপক সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা করেন। আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত গদর দল প্রবাসী শিখদের ইংরেজবিরোধী করে তুলেছিল। গদর দল শিখ সৈন্যদের সাহায্যে ভারতে বিদ্রোহ ঘটাতে সচেষ্ট হয়। তাই কোমাগাতামাৰু ও তোশামারু জাহাজে করে কয়েক হাজার গদর দলের সদস্য ভারতে আসেন। ইংরেজ সরকার তাদের অনেককে গ্রেফতার করে। অনেককে বিশেষ ট্রেনযোগে পাঞ্জাবে পৌঁছে দেয়। রাসবিহারী বসু ও যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এই গদর দলের সদস্যদের সাহায্যে লাহোর, আম্বালা, ফিরোজপুর, কানপুর, আগ্রা, বেনারস, এলাহাবাদ, ফৈজাবাদ এমনকি সিঙ্গাপুরের ভারতীয় বিশেষত শিখ ও মুসলমান সেনাদের প্রভাবিত করেন। স্থির হয় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত দিনে অভ্যুত্থান ঘটবে। কিন্তু কৃপাল সিংহ এই খবর ইংরেজদের জানিয়ে দেন। ফলে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। ব্যাপক গ্রেফতারি শুরু হয়। বন্দি বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয় এবং রাসবিহারী বসু ‘পি এন ঠাকুর’ ছদ্মনামে জাপানে পালিয়ে যান।
ভগৎ সিং-এর ভূমিকা
রুশ বিপ্লবের প্রভাবে ভারতেও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা প্রসার লাভ করে। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের সঙ্গে বিপ্লবী ভাবাদর্শ যুক্ত করে ভগৎ সিংহ ও তাঁর সহযোগীরা হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন (১৯২৫ খ্রি.)। ইতিমধ্যে সাইমন কমিশনবিরোধী বিক্ষোভের সময় পুলিশের লাঠির আঘাতে লালা লাজপত রায়-এর মৃত্যু ঘটে। ভগৎ সিংহ তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য লাহোরের সহকারী পুলিশ সুপার মি. স্যান্ডার্স-কে গুলি করে হত্যা করেন। এরপর ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লির কেন্দ্রীয় আইনসভায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটান (এপ্রিল, ১৯২৯ খ্রি.)। পুলিশ লাহোর ও সাহারানপুরে বোমা কারখানার সন্ধান পায় এবং তাদের বিরুদ্ধে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে (১৯২৯ খ্রি.) এবং বিচারে তাঁদের ফাঁসি হয় (২৩ মার্চ, ১৯৩১ খ্রি.)।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, বিপ্লবীদের অনেক পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও তাঁরা দেশপ্রেম ও ব্রিটিশ বিরোধিতাকে এক নতুন মাত্রায় পৌঁছে দেন।