নেপোলিয়নের সংস্কার গুলি লেখ

নেপোলিয়নের সংস্কার গুলি লেখ
নেপোলিয়নের সংস্কার গুলি লেখ

ভূমিকা: 

বিশ্বের ইতিহাসে নেপোলিয়নের জনপ্রিয়তা তাঁর সংস্কারমূলক কার্যাবলির জন্যই বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাঁর শাসনকাল ফ্রান্সের ইতিহাসে নেপোলিয়নের যুগ নামে পরিচিত। তাঁর সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ফরাসি জাতির মঙ্গলসাধন করা।

শাসনতান্ত্রিক সংস্কার: 

বিপ্লবজনিত কারণে দীর্ঘদিন ধরে ফ্রান্সে বিশৃঙ্খলা চলছিল। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার একমাত্র পথ হিসেবে নেপোলিয়ন শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রীকরণ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা বিলোপ করে ফ্রান্সকে ৪3টি প্রদেশে বিভক্ত করেন। প্রদেশগুলির যাবতীয় ক্ষমতা প্রথম কনসাল দ্বারা নিযুক্ত প্রিফেক্টদের হাতে রাখা হয়। প্রিফেক্টদের বিশেষ ধরনের পোশাক পরতে হত। সকল শ্রেণির সরকারি কর্মচারী, বিচারক প্রভৃতিকে প্রথম কনসাল দ্বারা নিযুক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়। সরকারি কর্মচারীদের দক্ষতার স্বীকৃতি স্বরূপ ‘লিজিয়ন অফ অনার’ নামক সম্মানসূচক উপাধি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

অর্থনৈতিক ও রাজস্ব সংস্কার: 

সরকারি দপ্তরগুলিতে নেপোলিয়ন ব্যয় সংকোচের জন্য দৃঢ়ভাবে নির্দেশ দেন। অর্থদপ্তরকে ভেঙে রাজস্ব দপ্তর গঠন করেন। নিয়মিত কর আদায় এবং বাড়তি কর নিষিদ্ধ করার আদেশ দেন। প্রাদেশিক সভার পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের কর আদায়ের নির্দেশ দেন। ব্যাবসাবাণিজ্যের উন্নতির জন্য নেপোলিয়ন 1800 খ্রিস্টাব্দে ‘ব্যাংক অফ ফ্রান্স’ গঠন করে 6% হারে অর্থ ঋণদানের ব্যবস্থা করেন। এর ফলে কৃষি এবং শিল্পেরও উন্নতি ঘটে। তিনি ‘চেম্বার অফ কমার্স’ এবং ‘স্টক এক্সচেঞ্জ স্থাপন করেন।

শিক্ষাসংক্রান্ত সংস্কার : 

জনসাধারণের শিক্ষার উন্নতির জন্য নেপোলিয়ন দেশে অনেক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। প্রতিটি কমিউনে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে মাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। কারিগরি শিক্ষার জন্যে বিশেষ বিদ্যালয়, আইন শিক্ষার জন্য কলেজ এবং শিক্ষক-শিক্ষণের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি জাতীয় গ্রন্থাগারের সংস্কার এবং জাতীয় মহাফেজখানার নতুন ভবন তৈরি করেন। 1808 খ্রিস্টাব্দে ‘ইউনিভার্সিটি অফ ফ্রান্স’ স্থাপন নেপোলিয়ানের শিক্ষানুরাগের পরিচয় দেয়।

কোড নেপোলিয়ান : 

নেপোলিয়ানের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হল কোড নেপোলিয়ন বা আইন-সংহিতা রচনা করা। কোড নেপোলিয়ন হল প্রাকৃতিক আইন, রোমান আইন ও বিপ্লবী আদর্শের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি আইনবিধি। এই আইন-সংহিতাতে মোট 2287টি ধারা ছিল। কোড নেপোলিয়নের তিনটি অংশ ছিল। যথা- (i) দেওয়ানি কোড, (ii) ফৌজদারি কোড এবং (iii) বাণিজ্যিক কোড। আইনের দৃষ্টিতে সব ব্যক্তির সমানাধিকার এবং সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এই আইন সংহিতার মূল উদ্দেশ্য। এই আইন সংহিতায় পৈতৃক সম্পত্তিতে সকলের সমানাধিকার, পরিবারতন্ত্রের উপর জোর এবং সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃত হয়।

ধর্মসংস্কার: 

ফরাসি সংবিধান সভা চার্চকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলে পোপের সঙ্গে ফরাসি সরকারের বিরোধ শুরু হয়েছিল। নেপোলিয়ান পোপ সপ্তম পায়াসের সঙ্গে এক চুক্তির মাধ্যমে এই বিরোধিতার অবসান ঘটান। এই চুক্তি ধর্মমীমাংসা চুক্তি বা কনকরডাট (1801 খ্রিস্টাব্দ) নামে পরিচিত। এই চুক্তি অনুসারে- (১) ক্যাথোলিক ধর্ম ফান্সে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পায়। (ii) সব ধর্মের প্রতি সহিষুতার নীতি গৃহীত হয়। (iii) স্থির হয় বিশপরা সরকার কর্তৃক মনোনীত হবেন, যদিও পোপ তাদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবেন। (iv) যাজকরা সরকারের কাছে আনুগত্যের শপথ নেবেন। (v) রাষ্ট্র বিশপ ও যাজকদের বেতন দেবে।

সমালোচনা: 

ঐতিহাসিক ফিশার বলেছেন, “যদিও নেপোলিয়ানের সাম্রাজ্য স্থায়ী হয়নি, কিন্তু তাঁর অসামরিক সংস্কারগুলি গ্রানাইট প্রস্তরের ভিত্তির ওপর স্থায়ীভাবে নির্মিত হয়েছিল।” কিন্তু এর বিরুদ্ধেও বিভিন্ন ঐতিহাসিক নানা প্রকার সমালোচনা করেছেন। নানা সংস্কারের মাধ্যমে নেপোলিয়ন ফরাসি বিপ্লবের সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ দুটিকে প্রতিষ্ঠিত করলেও অপর আদর্শ স্বাধীনতাকে অবহেলা করেন। ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকারকে ধ্বংস করে সকল ক্ষমতা নিজ হাতে কেন্দ্রীভূত করেন। তাই ঐতিহাসিকগণ তাঁকে বিপ্লবের ধ্বংসকারী বলেছেন। অবশ্য নেপোলিয়ন নিজেই বলেছেন-আমিই বিপ্লব ধ্বংস করেছিলাম (I destroyed the Revolution)। সুতরাং, নেপোলিয়ানকে প্রকৃতপক্ষে বিপ্লবের উত্তরাধিকারী বলা যায় না। তথাপি সাম্য ও মৈত্রীকে ফরাসি জনজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করে ফ্রান্সে প্রাক্-বিপ্লব যুগের অবস্থা ফিরে আসার সম্ভাবনাকে তিনি চিরতরে দূর করেন-এইখানেই নেপোলিয়নের সংস্কারের সার্থকতা।

Leave a Comment