নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যে জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধ দেখা গিয়েছিল তা আলোচনা করো |
নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধঃ
যে বোধ কোনো দেশের মানুষের মধ্যে ধর্ম-জাতির ভেদাভেদকে তুচ্ছ করে একাত্মবোধকে জাগিয়ে তোলে ও তাদের একত্রে বিপদআপদকে তুচ্ছ করে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্পে বলীয়ান হয়ে উঠতে সাহায্য করে আপাতদৃষ্টিতে তাকেই জাতীয়তাবাদ বলে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নেপোলিয়ান বিরোধী জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধ দেখা দিয়েছিল।
জার্মান জাতীয়তাবাদঃ
জার্মানির একমাত্র প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া ছাড়া সব ক-টি রাজ্যেই ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ানের নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হয়। প্রথম দিকে নেপোলিয়ানের মতন সুশাসক ও দক্ষ রণনিপুণ নেতৃত্ব লাভ করে জার্মান জাতি তথা কিছু দার্শনিক ও সাহিত্যিকগণ নেপোলিয়ানের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময় তাঁর স্বৈরাচারী শাসনপ্রণালীতে অত্যাচারিত হয়ে; তাঁর ক্ষমতালোভী, বংশগৌরবে বিশ্বাসী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী মনোভাবের পরিচয় লাভ করে জার্মানবাসীগণ তাঁর বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধের প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটায়।
স্পেনীয় জাতীয়তাবাদ:
স্পেন অধিকারের পর যখন ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান স্পেনের রাজা চতুর্থ চার্লস ও তাঁর পুত্র সপ্তম ফার্দিনান্দকে স্পেনের সিংহাসনের দাবি ত্যাগ করতে বাধ্য করেন এবং নিজ ভ্রাতা জোসেফ বোনাপার্টকে রাজপদে অভিষিক্ত করেন তখন স্পেনবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। যদিও নেপোলিয়ান গণসমর্থন আদায় করার চেষ্টায় স্পেনেও তাঁর সংস্কারমূলক কাজকর্ম করতে থাকেন তবুও তাঁর প্রচেষ্টাকে বিফল করে স্পেনীয় জনতা তাদের সীমিত সাধ্যমতো নানারকম চোরাগোপ্তা হামলা অথবা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ফরাসি বাহিনীকে বিব্রত করতে থাকে। নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে স্পেনবাসীর শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধের ফলে নেপোলিয়ান স্বয়ং আইবেরীয় উপদ্বীপ দখলের অভিযানে গিয়েও আইবেরীয় দ্বীপ দখলে ব্যর্থ হন। জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ স্পেনবাসী নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।
ফরাসি জাতীয়তাবাদ :
ফরাসি জনসাধারণ একদা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান নেপোলিয়ানের সুদক্ষ রণকৌশলে অভিভূত হয়ে তাঁকে ফ্রান্সের সম্রাটের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল, কিন্তু বিপ্লবী আদর্শের বাহক নেপোলিয়ানের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও স্বার্থপর মনোভাবের স্বরূপ প্রকাশ পেলে ফরাসি জনসাধারণও তাদের নির্বাচিত নেতা নেপোলিয়ানের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেয় ও তাঁর বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। নেপোলিয়ানের মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থার ফলে ইংল্যান্ডের জাহাজ ফ্রান্সের উপকূলে আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ফলে ইউরোপের বহু অঞ্চলের মতন ফ্রান্সেও কাঁচামালের আমদানি ও প্রস্তুত দ্রব্যের রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায় এবং বহু কলকারখানার উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও বেকারসমস্যা বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে আইবেরীয় অভিযান ব্যর্থ হওয়ার ফলে নতুন নতুন সামরিক অভিযানগুলির ব্যয় নির্বাহের জন্য করের পরিমাণ বাড়ানো হয়। ফলে ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত ফ্রান্সের জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধ গড়ে তোলে।