নেপোলিয়নের পতনের কারণগুলি আলোচনা করো

নেপোলিয়নের পতনের  কারণগুলি আলোচনা করো

ভূমিকা: 

কোনো সাম্রাজ্যেরই পতন একটিমাত্র কারণের জন্য ঘটে না। বিপ্লবের আদর্শকে হাতিয়ার করে খুব অল্প সময়ের মধ্যে নেপোলিয়ন যে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সাম্রাজ্য ওয়াটারলুর যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায়। হল্যান্ডরোজ, হার্বাট ফিশার, ফেলিক্স মার্কহ্যাম প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ এই পতনকে নানা কারণের সমন্বয় বলে উল্লেখ করেছেন।

নেপোলিয়ানের পতনের কারণ:

① পরস্পরবিরোধী চরিত্র: 

সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা ফরাসি বিপ্লবের এই তিনটি আদর্শকে হাতিয়ার করে নেপোলিয়ন ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র জয় করেন। বিজিত রাষ্ট্রগুলিতে তিনি সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ প্রতিষ্ঠা করলেও স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করেন। ফলে ওই দেশের জনগণের কাছে তিনি ঘৃণার পাত্রে পরিণত হন। তিনি জাতীয়তাবাদকে ফরাসি সাম্রাজ্য স্থাপনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ফরাসি জাতীয়তাবাদের অনুসরণে জার্মানি ও ইটালিতে জাতীয়তাবোধ জাগরিত হলে তিনি তা ধ্বংস করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। প্রতিবেশী সাম্রাজ্যগুলি নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যবাদ নীতির পরিপ্রেক্ষিতে সংঘবদ্ধ হয়। তারাই নেপোলিয়নের পতনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে।

② সীমাহীন উচ্চাকাঙক্ষা : 

সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও অপরিমেয় আত্মবিশ্বাস, নেপোলিয়নের পতনের অন্যতম কারণ। ঐতিহাসিক মার্শাল বলেছেন, নেপোলিয়ন ভুলে গিয়েছিলেন যে, মানুষ ঈশ্বর হতে পারে না। সত্যবাদী বা স্পষ্টবাদী পরামর্শদাতাদের তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তিনি শত্রুর ক্ষমতাকে তুচ্ছজ্ঞান করতেন। লিপজিগের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পরেও বিরোধী শক্তিজোটের প্রস্তাব যা তাঁর স্বার্থের উপযোগী ছিল তাও তিনি অহমিকাবশত প্রত্যাখ্যান করে নিজের বিপদ ডেকে আনেন।

③ মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা:

(ⅰ) ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অবরোধ কার্যকারী করার জন্য নেপোলিয়নকে নিরপেক্ষ দেশগুলিকে অধিকার করতে হয়। ফলে তাঁর সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র প্রকট হয়। (ii) ইউরোপের বৃহৎ অঞ্চল জুড়ে সৈন্য সংস্থাপন করলে তাঁর সৈন্যদল দুর্বল হয়ে পড়ে। (iii) পোপ কন্টিনেন্টাল সিস্টেম গ্রহণ করতে রাজি না হলে নেপোলিয়ন পোপকে বন্দি করে ক্যাথোলিক জগতে নিজের জনপ্রিয়তা হারান। স্পেন কন্টিনেন্টাল সিস্টেম গ্রহণে স্বীকৃত না হলে নেপোলিয়ন স্পেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। (iv) রাশিয়ার জার অবরোধ তুলে নেওয়ায় নেপোলিয়নের সঙ্গে জারের বিরোধ দেখা দেয়। (v) এই অবরোধের জন্যই জার্মানবাসীর দুঃখদুর্দশা বৃদ্ধি পেলে জাতীয়তাবাদী বিক্ষোভ তীব্র হয়।

④ উপদ্বীপের যুদ্ধ: 

স্পেনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে স্পেনবাসী জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ সংগ্রাম শুরু করে (1808-13 খ্রিস্টাব্দ)। ফলে ইউরোপীয় ভূখণ্ডে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর অবতরণ এবং সাফল্যজনকভাবে যুদ্ধ পরিচালনার পথ সুগম হয়।

⑤ মস্কো অভিযান: 

রাশিয়ার দূরত্ব, বিশালতা ও প্রতিকূল আবহাওয়ার কথা চিন্তা না করেই নেপোলিয়ান রাশিয়ার জারকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য 1812 খ্রিস্টাব্দে মস্কো অভিযান করেন। রাশিয়ার সেনাপতি কুটুজেভু ‘পোড়ামাটি নীতি’ গ্রহণ করলে নিজের নির্বুদ্ধিতার কথা বুঝতে পেরে নেপোলিয়ন রাশিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করেন। কিন্তু ঠান্ডা আবহাওয়ার পথকষ্টে এবং রাশিয়ানদের আক্রমণে তাঁর অপরাজেয় গ্র্যান্ড আর্মির বেশিরভাগ সৈন্য মারা যায়।

⑥ সৈন্যদের হতোদ্যম অবস্থা : 

দীর্ঘকাল ধরে দেশের বাইরে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার ফলে সৈন্যরা মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সৈন্যবাহিনীতে উপযুক্ত সৈনিকের অভাব দেখা দেয়। অনভিজ্ঞ ও অল্পবয়স্ক যুবকদের নিয়ে গঠিত নেপোলিয়ানের সৈন্যবাহিনীর পক্ষে নতুন করে যুদ্ধজয় বা সাম্রাজ্যরক্ষা করা সম্ভব ছিল না।

ইংল্যান্ডের বিরোধিতা: 

সবশেষে বলা যেতে পারে যে, ইংল্যান্ডের নৌশক্তিই নেপোলিয়ানের পতনে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। ট্রাফালগারের যুদ্ধে জয়লাভের পর ইংল্যান্ড সমুদ্রপথে অপরাজেয় হয়ে ওঠে। নেপোলিয়ান ইংল্যান্ডের বাণিজ্য ও বাজার নষ্ট করার জন্য কন্টিনেন্টাল সিস্টেম চালু করলে প্রভূত অর্থ ও চেষ্টার মাধ্যমে ইংল্যান্ড শক্তিজোট গড়ে তোলে। এই শক্তিজোটই নেপোলিয়ানের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটায়।

Leave a Comment