দ্বিতীয়ত, রায়ত তার নিজ খরচায় নীলচাষ করত। নীলকর বিঘা প্রতি মাত্র ২ টাকা অগ্রিম বা দাদন দিত। সুতরাং নীল কমিশনের হিসাব অনুযায়ী ১০ হাজার বিঘা রায়তি জমিতে নীলের চাষের জন্য নীলকরের খরচ পড়ত মাত্র ২০ হাজার টাকা। এর ফলে নীলকর সর্বদাই চেষ্টা করত রায়তকে তার নিজ জমিতে ধানের বদলে নীলচাষে বাধ্য করার জন্য। ফলে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নীলচাষিরা নীলচাষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহই নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
নীল বিদ্রোহের কারণ:
নীল বিদ্রোহের পিছনে একাধিক কারণ সক্রিয় ছিল। যথা-
[1] নীলকরদের অত্যাচার:
নীলকররা নীলচাষিদের নানাভাবে অত্যাচার করে নীলচাষ করতে বাধ্য করত। অনিচ্ছুক চাষিদের প্রহার করা, আটকে রাখা, স্ত্রী-কন্যার সম্মানহানি করা, চাষের সরঞ্জাম লুঠ করা, ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া প্রভৃতি নানাভাবে চাষিদের অত্যাচার করত। চাষিরা অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
[2] দাদন প্রথা:
নীলকররা চাষিদের দাদন বা অগ্রিম অর্থ দিত। অভাবের সময় চাষিরা অগ্রিম নিত। প্রতি বিঘায় ২ টাকা অগ্রিম দিয়ে চাষির সবচেয়ে ভালো জমিতে নীলচাষ করাতে বাধ্য করত। একবার কেউ দাদন নিলে সে আর নীলচাষের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারত না।
[3] প্রতারণা ও কারচুপি :
নীলকররা নীলচাষিদের বিভিন্নভাবে প্রতারিত করত। নীল কেনার সময় নীলের ওজন কম দেখাত, কম দামে নীল বিক্রি করতে বাধ্য করত; তা ছাড়া জোর করে বিভিন্নভাবে অর্থ আদায় করত।
[4] পঞ্চম আইন:
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক পঞ্চম আইন পাস করে ঘোষণা করেন যে, কোনো চাষি দাদন নিয়ে নীলচাষ না করলে তাকে গ্রেফতার করা হবে ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। এর ফলে নীলচাষিদের উপর অত্যাচার অনেক বেড়েছিল।
[5] অবিচার:
অত্যাচারিত নীলচাষিরা আদালতে গিয়েও সুবিচার পেত না। আইন ছিল নীলকরদের স্বার্থরক্ষার জন্য, চাষিদের জন্য নয়। তা ছাড়া পুলিশ, প্রশাসন সবই ছিল নীলকরদের পক্ষে।
[6] পত্রপত্রিকার প্রভাব:
নীলচাষিদের উপর নীলকরদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের কথা সে সময়কার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও লেখায় প্রকাশিত হয়েছে। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা এবং দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।
উপরোক্ত কারণগুলির ফলস্বরূপ নীলচাষিরা বিন্নুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।