দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল বা প্রভাব আলোচনা করো

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল বা প্রভাব আলোচনা করো
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল বা প্রভাব আলোচনা করো

ভূমিকা: 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে বলা হয় ‘হিটলারের যুদ্ধ’। কিন্তু এই যুদ্ধের জন্য ভার্সাই সন্ধি, মিত্রপক্ষের নানা কার্যাবলি, আদর্শগত দ্বন্দুও কম দায়ী ছিল না। এই যুদ্ধেই সর্বপ্রথম পারমাণবিক বোমার ধ্বংসলীলার সঙ্গে বিশ্ববাসী পরিচিত হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল বা প্রভাবঃ 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফলগুলিকে আমরা নিম্নলিখিতভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি-

① শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা: 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডবলীলা সমগ্র বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছিল। এসময় গোটা মানবসভ্যতা শান্তি প্রচেষ্টায় সামিল হয়েছিল। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অনেকগুলি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে আটলান্টিক সনদের নাম প্রথমেই বলতে হয়। এ ছাড়া মস্কো (1943), ইয়াল্টা (1945), পটসডাম (1945) সম্মেলনও উল্লেখযোগ্য ছিল।

② জাতিপুঞ্জ গঠন: 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে। ইয়াল্টা সম্মেলনে এই ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর সানফ্রান্সিসকো সম্মেলনে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ গঠিত হয়।

③ জার্মানির ভাগ্যলিখন: 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রপক্ষের দেশগুলি জার্মানির ভবিষ্যৎ নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। মূলত ইয়াল্টা ও পটসডাম সম্মেলনে এই নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঠিক হয় জার্মানিকে ইংল্যান্ড, রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে। জার্মানি থেকে নাতসি প্রভাব বিলুপ্ত করে সেখানে পুনর্গঠনের ব্যবস্থা করা হবে। জার্মানিকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বলেও নির্দেশ দেওয়া হয়। এই ভাবে মিত্রপক্ষের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিতে নতুন জার্মানি তৈরির চেষ্টা করা হয়।

④ পোল্যান্ড গঠন: 

পোল্যান্ডকে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে সেখানে একটি স্থায়ী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। পোল্যান্ড সম্পর্কিত বেশ কিছু সিদ্ধান্ত এই সময় নেওয়া হয়।

⑤ আর্থিক পুনর্বাসন: 

যুদ্ধের সঙ্গে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি জড়িয়ে থাকে। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমগ্র পৃথিবীতে কমবেশি আর্থিক প্রভাব ফেলেছিল। এই সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলিকে মিত্রপক্ষ আর্থিক পুনর্বাসন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। জাতিপুঞ্জের একটি সংস্থা United Na- tions Relief and Rehabilitation Administra- tion (UNRRA) পোল্যান্ড, ইটালি, যুগোশ্লাভিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়ায় অন্ন, বস্ত্র, খাদ্য, চিকিৎসা দিয়ে নানাভাবে সাহায্য করে।

⑥ ঠান্ডা লড়াইয়ের সূত্রপাতঃ 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীতে Cold War বা ঠান্ডা লড়াই নামক এক নতুন পরিস্থিতির জন্ম দেয়। এই সময় একদিকে আমেরিকার নেতৃত্বে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট, অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোটের মধ্যে এক স্নায়বিক উত্তেজনাপূর্ণ বিশেষ পরিস্থিতির জন্ম হয়েছিল। যুদ্ধের সমস্ত উত্তেজনা, সমরাস্ত্র, প্রযুক্তিবিদ্যার উপস্থিতি সত্ত্বেও এখানে কোনো রণাঙ্গনের যুদ্ধ হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যাবতীয় ঘটনার কেন্দ্রস্থলে ছিল এই ঠান্ডা লড়াই।

⑦ সাম্রাজ্যবাদের পতন: 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে যে সাম্রাজ্যবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল তা যুদ্ধের পর অনেকাংশে কমে যায়। এই সময় বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জন্মলাভ করে। এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশ এই সময় স্বাধীনতা লাভ করে।

⑧ জাতীয়তাবাদের বিকাশঃ 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ একপ্রকারে ছিল একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক দেশগুলির সাফল্য। ফলে গণতন্ত্র জয়যুক্ত হলে সমগ্র বিশ্বে নতুন আবহের সূত্রপাত হয়। সমাজতন্ত্র ও ধনতন্ত্রে বিভক্ত পৃথিবীর মেরুকরণে জাতীয়তাবাদী মানসিকতা গড়ে উঠতে থাকে। এই সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদের বিকাশও ঘটতে থাকে।

উপসংহার: 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় পৃথিবীর ওপর কিছু তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছিল। কিন্তু এই ঘটনার সুদূরপ্রসারী ফল ছিল আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এই যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্রের ধ্বংসলীলা থেকে মানবজাতি যে শিক্ষা নিয়েছিল, তা হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে আজও আটকে রেখেছে।

Leave a Comment