দেশবিভাগ (১৯৪৭ খ্রি.) জনিত উদ্বাস্তু সমস্যা টিকা |
ভূমিকা
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট মুসলিম লিগ-এর প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট দেশভাগ ও ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর উদ্বাস্তু সমস্যা প্রবল আকার ধারণ করে।
উদ্বাস্তু সমস্যা
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যার কারণ ও প্রকৃতি ছিল নিম্নরূপ–
দেশভাগ
ভারত বিভক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। ভারত বিভাজনের অংশ হিসেবে পাঞ্জাব ও বাংলা বিভক্ত হয়। ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন হওয়ায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিম পাঞ্জাবের শিখরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। একইভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলায় হিন্দুরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। এ ছাড়া সিন্ধু প্রদেশের হিন্দুরা সংখ্যালঘু ছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নিরাপত্তার অভাববোধের জন্য তারা ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসে। এদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২ কোটি।
ভারতের জনসংখ্যাবৃদ্ধি
দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ১ কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। এরা পায়ে হেঁটে, গোরুর গাড়িতে, ট্রেনে, নৌকায় বিভিন্নভাবে পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসে। এর ফলে ভারতের জনসংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে।
আশ্রয়দান
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা ছিল প্রথম কাজ। উদ্বাস্তুরা বড়ো-ছোটো রেলস্টেশনে, ফাঁকা জায়গায় থাকতে শুরু করে। যাদের সঙ্গে কিছু অস্থাবর সম্পদ (টাকা, সোনা) ছিল তারা বাড়ি কিনে নেয় বা বাড়ি ভাড়া করে। যাদের তেমন কিছুই ছিল না তারা দিনের বেলা কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়াত, জনমজুরের কাজ করত আর রাতে স্টেশন চত্বরে বা ফাঁকা জায়গায় থাকত।
ত্রাণ ও পুনর্বাসন
পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী ভারতের রাজ্যগুলিতে উদ্বাস্তুরা আশ্রয় নেয়। এর ফলে স্থানীয় জনসংখ্যার উপর চাপ পড়ে ও বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। এজন্য কেন্দ্রীয় সরকার উদ্বাস্তু সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে ত্রাণ ও পুনর্বাসন নীতি গ্রহণ করে। পূর্ব পাঞ্জাব, দিল্লি, রাজস্থান, পশ্চিমবাংলা, আসাম ও ত্রিপুরায় সরকারি উদ্যোগে আশ্রয় শিবির, খাদ্য সরবরাহ, অর্থ সাহায্য ও নিরাপত্তা দেওয়া হয়। তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
অর্থনৈতিক সমস্যা
উদ্বাস্তুরা আসার ফলে তাদের খাওয়াপরা ও কর্মসংস্থান করার জন্য ভারতের অর্থনীতিতে প্রবল চাপ পড়ে। উদ্বাস্তুদের চাপ সামলানোর জন্য ভারত সরকারকে বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়।
স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধ
ভারতে আসা উদ্বাস্তুদের সঙ্গে স্থানীয় জনগণের নানারকম বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। তারা স্থানীয় জনগণের কাজে ভাগ বসিয়েছিল। তা ছাড়া তাদের ধর্ম, ভাষা, পোশাক-পরিচ্ছদ এক হলেও সংস্কৃতিগত পার্থক্য ছিল। এর ফলে পাকিস্তান থেকে আগত মানুষদের সঙ্গে বাংলা ও পাঞ্জাবের মানুষের মেলবন্ধন ঘটেনি। উভয়ের পৃথক সত্তা বজায় ছিল।
আন্তঃ ডোমিনিয়ন সম্মেলন
উদ্বাস্তু সমস্যার ভয়াবহতার জন্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সরকারি স্তরে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় (এপ্রিল, ১৯৪৮ খ্রি.)। হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা এবং দাঙ্গা না হওয়া এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল।
দিল্লি চুক্তি
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশভাগের পর পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু স্রোত ভারতে প্রবেশ করতে থাকে। এই উদ্বাস্তু স্রোত নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নেহরু ও লিয়াকৎ আলি খানের মধ্যে দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় (এপ্রিল, ১৯৫০ খ্রি.)। সংখ্যালঘুদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকা, প্রতিকার প্রার্থনা, দাঙ্গা রোধ করা, উদ্বাস্তু হতে না দেওয়া, দেশত্যাগীদের সম্পত্তি-সহ আসার ক্ষেত্রে আইনগত সাহায্য করা এই চুক্তির বিষয়বস্তু ছিল। এইভাবে ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যার ভয়াবহতা সৃষ্টি হয়।