জার্মানির ঐক্য আন্দোলনে বিসমার্কের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করো। |
বিসমার্কের ভূমিকা:
জার্মানির জাতীয়তাবাদ বিকাশে অটো ভন বিসমার্ক ছিলেন এক অন্যতম ব্যক্তিত্ব। কূটনীতির জাদুকর বিসমার্ক তাঁর ‘রক্ত ও লৌহনীতি’-র প্রয়োগ ঘটিয়ে সমগ্র জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। 1862 খ্রিস্টাব্দে জার্মানির এক বিশেষ পরিস্থিতিতে বিসমার্ক প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন এবং তিনটি যুদ্ধের মাধ্যমে জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। এই তিনটি যুদ্ধ হল-① ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধ, ② অস্ট্রো-প্রাশীয় যুদ্ধ (স্যাডোয়ার যুদ্ধ), ③ ফ্রাঙ্কো-প্রাশীয় যুদ্ধ (সেডানের যুদ্ধ)।
ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধ:
কূটনীতির জাদুকর বিসমার্ক প্রথম ডেনমার্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। একাজে তার অস্ট্রিয়ার সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। তাই তিনি প্রথমেই অস্ট্রিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন। এরপর তার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে শ্লেজউইগ ও হলস্টেইন সমস্যাকে কাজে লাগান। এই স্থান দুটি ডেনমার্ক ও জার্মানির সীমানায় অবস্থিত ছিল। আইনত স্থান দুটি ডেনমার্কের অধীনে ছিল। ডেনমার্কের রাজা স্থান দুটিকে তার সীমানার অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলে বিসমার্ক ডেনমার্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন (1864 খ্রিস্টাব্দ)। এই যুদ্ধে তাঁর সঙ্গে ছিল অস্ট্রিয়া। ভিয়েনা চুক্তি অনুসারে ডেনমার্ক ওই স্থান দুটির ওপর তার অধিকার ত্যাগ করে। কিন্তু এরপর স্থান দুটির অধিকার নিয়ে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে প্রাশিয়ার দ্বন্দু শুরু হয়। অবশেষে 1865 খ্রিস্টাব্দে গ্যাস্টিনের সন্ধি দ্বারা হলস্টেইন পায় অস্ট্রিয়া আর শ্লেজউইগ পায় প্রাশিয়া।
অস্ট্রো-প্রাশীয় যুদ্ধ:
জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য অস্ট্রিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য ছিল। কারণ, জার্মানির বহু অঞ্চলের উপর অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই এরপর বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন। প্রস্তুতি হিসেবে তিনি প্রথমেই অস্ট্রিয়াকে মিত্রহীন করার চেষ্টা করেন। এরপর রাশিয়া, ফ্রান্স ও ইটালিকে কূটনীতির দ্বারা নিজ পক্ষে আনেন। ঠিক হয় এই যুদ্ধে রাশিয়া ও ফ্রান্স নিরপেক্ষ থাকবে। বিনিময়ে তারা কিছু ভূখণ্ড পাবে। আর ইটালি অস্ট্রিয়া বিরোধী এই যুদ্ধে যোগদান করে বিনিময়ে ভেনেশিয়া পাবে।
যুদ্ধ:
বিসমার্ক এইভাবে সমস্ত আয়োজন শেষ করে, গ্যাস্টিনের সন্ধি ভঙ্গের অজুহাতে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এটি স্যাডোয়ার যুদ্ধ (16 জুন, 1866) নামে পরিচিত। একে আবার, সাত সপ্তাহের যুদ্ধ নামেও অভিহিত করা হয়। এই যুদ্ধে অস্ট্রিয়ার পরাজয় ঘটে। 1866 খ্রিস্টাব্দের 23 আগস্ট অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার মধ্যে ‘প্রাগের সন্ধি’-র দ্বারা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
ফলাফল:
① এই যুদ্ধের ফলে প্রাশিয়ার জাতীয়তাবাদ আরও মজবুত এবং তার আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। ② জার্মানির ওপর থেকে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্যের অবলুপ্তি ঘটে। ③ শ্লেজউইগ, ফ্রাঙ্কফুর্ট, হ্যানোভার, ক্যাসেল, ন্যাসো, হলস্টেইন, হেসি প্রভৃতি প্রাশিয়ার অধীনস্থ হয়। ④ ইটালিতে পিডমন্টের সঙ্গে ভেনিস যুক্ত হওয়ায় ইটালির ঐক্য সম্পূর্ণ হয়। ⑤ প্রাশিয়ার নেতৃত্বে জার্মানিতে রাষ্ট্রসংঘ গঠিত হয়। ⑥ অস্ট্রিয়ার পরাজয়ের ফলে মধ্য ইউরোপের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ভিয়েনা থেকে বার্লিনে সরে আসে।
ফ্রাঙ্কো-প্রাশীয় যুদ্ধ :
বিসমার্ক জানতেন যে, জার্মানির সঙ্গে ফ্রান্সের যুদ্ধ অনিবার্য। কারণ, দক্ষিণ জার্মানির বহু অংশের উপর তখনও ফ্রান্সের প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল। তাই বিসমার্ক ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন। প্রথমেই তিনি ফ্রান্সকে কূটনীতির দ্বারা মিত্রহীন করার চেষ্টা করেন। এরপর বিসমার্ক অস্ট্রিয়া ও ইটালিকে নিজ পক্ষে আনেন। প্রাগের সন্ধিতে বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে কোনো কঠিন শর্ত চাপাননি। ফলে সে প্রাশিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। আর ইটালিকে রোম দেওয়ার লোভ দেখিয়ে তাকে দলে টানেন।
যুদ্ধ:
অবশেষে বিসমার্কের কূটনীতির কারণে এমস টেলিগ্রামের সূত্র ধরে ফ্রান্স প্রাশিয়াকে আক্রমণ করে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, অস্ট্রো-প্রাশিয়া যুদ্ধের সময় থেকেই ফ্রান্স প্রাশিয়ার প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। কারণ, যুদ্ধের পর ফ্রান্স তার আকাঙ্ক্ষিত জায়গাগুলি পায়নি। তা ছাড়া শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রাশিয়ার উত্থান ফরাসিবাসী মেনে নিতে পারেনি। যাই হোক, অবশেষে যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় হয়। 1871 খ্রিস্টাব্দের 10 মে ফ্রাঙ্কফুর্ট সন্ধির দ্বারা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
ফলাফল:
প্রাশিয়া ফ্রান্সের কাছ থেকে ঘেটজ, আলসাস ও লোরেন লাভ করে। ② ইটালি ও জার্মানির ঐক্য আন্দোলন সম্পূর্ণ হয়। ③ ক্ষতিপূরণ হিসেবে ফ্রান্স প্রাশিয়াকে 500 কোটি লিভ্র প্রদান করে। ④ ফ্রান্সে তৃতীয় নেপোলিয়ানের পতন ঘটে। ⑤ ফ্রান্সে তৃতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ⑥ প্রাশিয়ার সম্রাট প্রথম উইলিয়াম ঐক্যবদ্ধ জার্মানির সম্রাট হন।
এইভাবে জার্মানি একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ইটালির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং সেখানে জাতি-রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া যে সময়সাপেক্ষ আবর্তময় জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল তা বিশ্ববাসীর বুঝতে বিশেষ দেরি হয়নি।