ঔপনিবেশিক ভারতে আদিবাসী ও কৃষক বিদ্রোহগুলির পরিচয় দাও

ঔপনিবেশিক ভারতে আদিবাসী ও কৃষক বিদ্রোহগুলির পরিচয় দাও
ঔপনিবেশিক ভারতে আদিবাসী ও কৃষক বিদ্রোহগুলির পরিচয় দাও।

ভূমিকা

ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার পর প্রায় ১০০ বছর ধরে ব্রিটিশ, জমিদার ও মহাজনদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে অনেক উপজাতি ও কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল। এই সকল বিদ্রোহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- চুয়াড় বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুণ্ডা বিদ্রোহ, ভিল বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ, ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ ইত্যাদি।

ঔপনিবেশিক ভারতে বিভিন্ন আদিবাসী ও কৃষক বিদ্রোহ

চুয়াড় বিদ্রোহ

আদিবাসী চুয়াড় জনগোষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশ ও বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে বসবাস করত। তারা কৃষিকাজ ও পশুশিকারের পাশাপাশি স্থানীয় জমিদারদের অধীনে পাইকের কাজ করত। এর বিনিময়ে কিছু নিষ্কর জমি ভোগ করার অধিকার তারা পেয়েছিল। এমতাবস্থায় ব্রিটিশ কোম্পানি করের বোঝা বাড়িয়ে দিলে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, মানভূম প্রভৃতি অঞ্চলে ১৭৬৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ব্রিটিশ সরকার ও তার সহযোগী জমিদারদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ শুরু হয়, তা চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহ মেদিনীপুর, বাঁকুড়া অঞ্চলে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। চুয়াড় বিদ্রোহের নেতা ছিলেন দুর্জন সিংহ, রানি শিরোমণি, জগন্নাথ সিং ধল, অচল সিংহ প্রমুখ। ব্রিটিশ সরকারের প্রচণ্ড দমনপীড়নের ফলে চুয়াড় বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়।


কোল বিদ্রোহ

কোলরা হল বিহারের ছোটোনাগপুর অঞ্চলে বসবাসকারী এক উপজাতি। তারা ইংরেজ, মহাজন ও বহিরাগত দিকুদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করেছিল, তা কোল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে কোলরা প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তবে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। কোল বিদ্রোহের নেতা ছিলেন- বুদ্ধু ভগত, জোয়া ভগত, ঝিন্দরাই মানকি, সুই মুণ্ডা প্রমুখ। ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহীদের উপর তীব্র দমননীতি প্রয়োগ করে এবং বহু আদিবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করলে বিদ্রোহ ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে যায়।

সাঁওতাল বিদ্রোহ

সাঁওতালরা হল কঠোর পরিশ্রমী, শান্তিপ্রিয় ও কৃষিজীবী সম্প্রদায়। আদিবাসী সাঁওতালরা পালামৌ, মানভূম, রাঁচি, হাজারিবাগ, বীরভূম, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ বনভূমি অঞ্চলে বসবাস করত। ইংরেজরা তাদের উপর বিপুল পরিমাণ রাজস্বের বোঝা চাপিয়ে দেয়। মহাজনরা সাঁওতালদের চড়া সুদে ঋণ দিত এবং কম মজুরি দিয়ে বিভিন্ন পরিশ্রমসাধ্য কাজ করাত। খ্রিস্টান মিশনারিরাও তাদের জোর করে ধর্মান্তরিত করত। এ ছাড়া নীলকর সাহেবরাও তাদের খাদ্যশস্যের পরিবর্তে নীলচাষ করতে বাধ্য করত। ফলে রাজমহল পাহাড়ের প্রান্তদেশ বা ‘দামিন-ই-কোহ’ অঞ্চলে ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতালরা যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তা সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন- সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব, কালো প্রামাণিক, ডোমন মাঝি প্রমুখ।

তবে এই বিদ্রোহ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি। সরকার সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকায় সুদের হার বেঁধে দেয় এবং সাঁওতালদের জন্য পৃথক সাঁওতাল পরগনা গঠন করা হয়। সেখানে মহাজনদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।

মুণ্ডা বিদ্রোহ

আদিবাসী মুণ্ডারা ছোটোনাগপুর ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে বসবাস করত। এই সমস্ত অঞ্চলে ব্রিটিশ সরকার মুন্ডাদের প্রচলিত ‘খুৎকাঠি’ প্রথা বাতিল করে ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠা করে। এর প্রতিবাদে ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে মুন্ডারা ইংরেজ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তা মুণ্ডা বিদ্রোহ নামে পরিচিত। মুণ্ডা বিদ্রোহের নেতা ছিলেন বিরসা মুণ্ডা। তাঁকে ‘ধরতি আবা’ বলা হত। বিদ্রোহের পরবর্তীকালে মুন্ডাদের খুৎকাঠি প্রথা কিছুটা স্বীকৃতি লাভ করে এবং তাদের বেগার খাটানো বন্ধ হয়।

ভিল বিদ্রোহ

ভারতের উপজাতি সম্প্রদায়ের অপর একটি শাখা ভিল জাতি বসবাস করত গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের খান্দেশ অঞ্চলে। তারা কঠোর পরিশ্রম করে সেখানকার পাথুরে জমিতে ফসল ফলাত। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের পর এই সমস্ত অঞ্চলে ব্রিটিশ ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা চালু হলে ভিলদের উপর রাজস্বের বোঝা বহুগুণ বেড়ে যায়। তারা চরম শোষণ, অত্যাচার ও দুর্দশার শিকার হয়। ফলে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে ভিলরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ছিলেন শিউরাম।


সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ

সুলতানি আমল থেকেই উত্তর ভারতের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের বহু সন্ন্যাসী ও ফকির বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন অংশে তীর্থভ্রমণে আসত। ফিরে যাওয়ার সময় তারা ভূস্বামীদের কাছ থেকে অনুদান লাভ করত। অনেকেই এই সমস্ত অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। কৃষিকাজই ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সন্ন্যাসী ও ফকিররা ইংরেজ কোম্পানি ও তাদের সহযোগী জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ সংগঠিত করেছিল, তা সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহ ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, মেদিনীপুর, বীরভূম প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী, মজনু শাহ, মুসা শাহ প্রমুখ।


ওয়াহাবি আন্দোলন

‘ওয়াহাবি’ কথার অর্থ নবজাগরণ। আরবদেশে আবদুল ওয়াহাব ইসলাম ধর্মের সংস্কারের জন্য যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তা ওয়াহাবি আন্দোলন নামে পরিচিত। বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন তিতুমির। তিতুমির ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার, জমিদার, মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই বিদ্রোহ বারাসত বিদ্রোহ নামেও পরিচিত।


ফরাজি আন্দোলন

‘ফরাজি’ কথার অর্থ ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য। ফরাজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হাজি শরিয়ৎউল্লাহ। এই আন্দোলন বাংলার ফরিদপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোহর প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। শরিয়ৎউল্লাহ-র পর দুদু মিঞা ও নোয়া মিঞা এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।

নীল বিদ্রোহ

বাংলায় কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে নীল বিদ্রোহের নাম চিরস্মরণীয়। নীলকররা সীমাহীন শোষণ, অত্যাচার ও পীড়নের মাধ্যমে দরিদ্র কৃষকদের নীলচাষে বাধ্য করত। কৃষকরা খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে পারত না। নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলার ক্ষুব্ধ কৃষকরা ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে যে বিদ্রোহ শুরু করে, তা নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। নদিয়ার কৃষ্ণনগরের চৌগাছা গ্রামের দিগম্বর বিশ্বাস ও বিন্নুচরণ বিশ্বাস নীল বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। বিদ্রোহ ক্রমে যশোহর, খুলনা, ফরিদপুর, মুরশিদাবাদ, রাজশাহী, মালদহ প্রভৃতি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।


উপসংহার

ক্যাথলিন গফ উপরোক্ত বিদ্রোহগুলিকে ‘হারিয়ে যাওয়া অধিকারের পুনরুদ্ধারমূলক বিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করেছেন। কোম্পানি এবং তাদের সহযোগী জমিদার ও মহাজনরা আদিবাসী ও কৃষকদের চিরাচরিত অধিকারগুলি হরণ করার ফলেই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং বিভিন্ন বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে। কোনো কোনো বিদ্রোহ ধর্মাশ্রয়ী হলেও তাদের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল ইংরেজ শাসন ও শোষণের অবসান।

Leave a Comment