ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী ছিল? তিতুমিরের নেতৃত্বে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো। |
ওয়াহাবি আন্দোলন
ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন দিল্লির বিখ্যাত মুসলিম সন্ত শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তাঁর পুত্র আজিজ। তবে ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রায়বেরিলির অধিবাসী সৈয়দ আহমদ এবং বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তিতুমির।
ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য
[1] ইসলাম ধর্মের সংস্কার : ‘ওয়াহাবি’ আন্দোলনের প্রকৃত নাম হল ‘তারিকা-ই-মহম্মদীয়া’ অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মহম্মদ প্রদর্শিত পথ। ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম ধর্মের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কার দূর করে মহম্মদের নির্দেশ অনুসরণ করে ইসলাম ধর্মের সংস্কার করা।
[2] ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজদের বিতাড়ন: ওয়াহাবি আন্দোলনকারীরা বিধর্মী ইংরেজ-শাসিত ভারতকে ‘দার-উল-হারব’ (শত্রুর দেশ) বলে অভিহিত করত। তাই তারা ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবর্ষ থেকে বিধর্মী ইংরেজদের বিতাড়িত করার জন্য আন্দোলন করেছিল।
[3] অত্যাচারী জমিদারদের উচ্ছেদ: ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল অত্যাচারী জমিদারদের উচ্ছেদ করা। এই কারণে পাঞ্জাবের অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে সৈয়দ আহমদ যুদ্ধ করে পেশোয়ার দখল করেছিলেন এবং বাংলায় তিতুমির পুড়ার জমিদারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
[4] নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শ : ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল এক সহজসরল জীবনযাত্রা এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
তিতুমিরের নেতৃত্বে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন মির নিশার আলি, যিনি তিতুমির নামে অধিক পরিচিত। তিতুমির ২৪ পরগনা জেলার বাদুড়িয়া থানার অন্তর্গত হায়দারপুর গ্রামের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মক্কায় হজ করতে গিয়ে সৈয়দ আহমদের সংস্পর্শে আসেন এবং দেশে ফিরে ইসলাম ধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। পরবর্তীকালে এই আন্দোলন কৃষক আন্দোলন-এ পরিণত হয়েছিল। বারাসত অঞ্চলে তিতুমিরের এই আন্দোলন বারাসত বিদ্রোহ নামেও পরিচিত।
তিতুমিরের আন্দোলনের মূল কথা
তিতুমিরের আন্দোলনের মূল কথা ছিল-
[1] একমাত্র আল্লাহকে মান্য করতে হবে।
1 2 মুসলমানদের ইসলাম ধর্মবহির্ভূত সংস্কার পরিত্যাগ করতে হবে।
[3] অনুগামীদের দাড়ি রাখতে হবে।
[4] অত্যাচারী জমিদারদের রাজস্ব দাবির বিরোধিতা করতে হবে।
তিতুমিরের বিরুদ্ধে জমিদারদের প্রতিক্রিয়া
তিতুমিরের প্রভাবে ২৪ পরগনা, নদিয়া, মালদহ, রাজশাহি, ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষকরা ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করলে জমিদার, নীলকর সাহেব ও মুসলমান মোল্লারা তিতুমিরের বিরোধিতা করে। পুড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় তিতুমিরের অনুগামীদের দমন করার জন্য দাড়ির উপর ২১%, টাকা কর ধার্য করেছিলেন। ফলে জমিদারের সঙ্গে তিতুমিরের অনুগামীদের সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল।
বারাসত বিদ্রোহ
তিতুমির বারাসতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজেকে স্বাধীন ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন ও মইনুদ্দিন নামে এক অনুগামীকে প্রধানমন্ত্রী এবং ভাগ্নে গোলাম মাসুমকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করার পরিকল্পনা করেন। তিনি নারকেলবেড়িয়ার সদর দপ্তরে ‘বাঁশের কেল্লা’ নির্মাণ করে ওই অঞ্চলের জমিদারদের কাছে রাজস্ব দাবি করেন। এটি ইতিহাসে বারাসত বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
বারাসত বিদ্রোহের অবসান
তিতুমিরের বিরুদ্ধে স্থানীয় জমিদার ও নীলকর সাহেবরা গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্কের শরণাপন্ন হলে লর্ড বেন্টিঙ্ক তিতুমিরের বিরুদ্ধে বিশাল সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে তিতুমিরের বাহিনীর অসম যুদ্ধে তিতুমির ও তাঁর বহু অনুগামী মৃত্যুবরণ করেন। ফলে বারাসত বিদ্রোহের অবসান ঘটে।
উপসংহার
ধর্মীয় চেতনা ওয়াহাবি আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। জমিদারদের বিরোধিতা থেকে এই আন্দোলন শেষপর্যন্ত ইংরেজ সরকারের বিরোধিতায় পরিণত হয়েছিল।