উনিশ শতকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সভাসমিতিগুলির বিবরণ দাও

উনিশ শতকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সভাসমিতিগুলির বিবরণ দাও
উনিশ শতকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সভাসমিতিগুলির বিবরণ দাও।

১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি অধিকার লাভ এদেশে ইংরেজ রাজত্বের সূচনা করে। শুরু হয় শাসন ও শোষণের যুগ। শিক্ষাপ্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে একটি শিক্ষিত ও সচেতন শ্রেণি গড়ে ওঠে এবং দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবোধ জেগে ওঠে। এর ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভাসমিতির জন্ম হয়।

সভাসমিতিসমূহ

উনিশ শতকে কলকাতা তথা বাংলা প্রেসিডেন্সিতে বিভিন্ন সভাসমিতি গড়ে ওঠে।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা

ইংল্যান্ডের অনুকরণে এদেশে প্রথম যুগে যে-সমস্ত রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা।

প্রতিষ্ঠা: ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর কলকাতায় এই সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ২৪ পরগনা (উত্তর) জেলার টাকির জমিদার কালীনাথ রায়চৌধুরী, প্রসন্নকুমার ঠাকুর এবং প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ এই সভার প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। এই সভার প্রতিষ্ঠাতাগণ সবাই জমিদার ছিলেন।

উদ্দেশ্য: সভার সদস্যরা গোচারণভূমি বা পতিত জমিতে সরকারের কর বসানোর বিরোধিতা করেন। এই সভার রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতা ও সমতার আদর্শকে তারা সম্মান করতেন। তারা বিশ্বাস করতেন পাশ্চাত্য শিক্ষা ভারতের উন্নতিসাধন করবে। তারা এদেশে ইংল্যান্ডের মতো সম-অধিকার নীতির বাস্তবায়ন চাইতেন। লক্ষ্যপূরণের জন্য এই সভায় ইংরেজ সদস্য নেওয়া হয়। ব্রিটিশ শাসনকে তারা ‘ঐশ্বরিক দান’ বলে মনে করতেন।

জমিদার সভা

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত সভাসমিতিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জমিদার সভা।

এই সভার উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণের স্বার্থরক্ষার্থে সরকারি শাসনব্যবস্থার ত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা করা এবং ত্রুটিগুলি দূর করার জন্য সরকারের কাছে আবেদনপত্র পেশ করা।

প্রতিষ্ঠা: ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ নভেম্বর কলকাতায় এই সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার সময় এই সভার নাম ছিল জমিনদারি অ্যাসোসিয়েশন। পরে এর নাম হয় ল্যান্ডহোল্ডার্স সোসাইটি (Landholders Society) বা ভূম্যধিকারী সভা। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রমুখ।

উদ্দেশ্য: প্রতিষ্ঠাতা সদস্যগণ সবাই জমিদার ছিলেন। তাই জমিদারি স্বার্থরক্ষা এই সভার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। ব্রিটিশ সরকারের ভূমিরাজস্ব নীতি জমিদারদের ভীত করেছিল। তাই সরকারি নীতির বিরোধিতা ও প্রতিরোধ করা এই সভার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে।

দাবিসমূহ: এই সভা বিভিন্ন দাবি পেশ করে। সেগুলি ছিল- ① নিষ্কর জমি বাজেয়াপ্ত হতে না দেওয়া। ② ব্রিটিশ ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রসার। ③ বিচার, পুলিশ ও রাজস্ব বিভাগের সংস্কার। ④ সুবিধাজনক শর্তে পতিত জমির ইজারাদান প্রভৃতি।

এ ছাড়া এই সভা বিভিন্ন কার্যকলাপের মাধ্যমে প্রজাকল্যাণ ও স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ দেখায়।

ভারতসভা 

আঞ্চলিকতার সীমা ছাড়িয়ে সারা ভারতব্যাপী যে রাজনৈতিক সভা গড়ে ওঠে, তার নাম হল ভারতসভা (Indian Association)।

প্রতিষ্ঠা: ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ভারতসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু ও শিবনাথ শাস্ত্রী।

উদ্দেশ্য: দেশে জনমত গড়ে তোলা, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করা, হিন্দু-মুসলিম মৈত্রীর প্রসার এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে সাধারণ মানুষদের যোগদানের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি।

শাখাসমূহ: কলকাতা ছাড়াও এলাহাবাদ, কানপুর, লখনউ, মিরাট, লাহোর প্রভৃতি স্থানে ভারতসভার শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।

আন্দোলন: ইংরেজ সরকার আই সি এস পরীক্ষার বয়সসীমা ২৩ বছর থেকে কমিয়ে ১৯ বছর করলে এর প্রতিবাদে এই সভা আন্দোলন করে। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার স্ট্যাটুটারি সিভিল সার্ভিস প্রবর্তন করে। এই সভা দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইন, অস্ত্র আইনের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করে। এ ছাড়া এই সভা ইলবার্ট বিলের সমর্থনেও আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়।

হিন্দুমেলা

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশে গড়ে ওঠা অপর গুরুত্বপূর্ণ সভাটি হল হিন্দুমেলা।

প্রতিষ্ঠা: ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে নবগোপাল মিত্র কলকাতায় হিন্দুমেলা প্রচলন করেন। তিনি এ বিষয়ে রাজনারায়ণ বসু এবং জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সহযোগিতা পেয়েছিলেন।

উদ্দেশ্য: হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করা, হিন্দু জাতীয়তাবোধের বিকাশ, আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তোলা এবং দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলা প্রভৃতি এর উদ্দেশ্য ছিল।

কর্মসূচি: মেলার সূচনার দিন দেশের স্তবগান, দেশাত্মবোধক কবিতা পাঠ করা হত। তারপর দেশীয় শিল্প, ব্যায়াম প্রদর্শিত হত। শেষে দেশের গুণী ব্যক্তিত্বরা পুরস্কৃত হতেন।

অবদান : দেশাত্মবোধের বিকাশ, বাংলা ভাষার চর্চা ও রচনা, হস্তশিল্প বিকাশে উৎসাহ, জাতীয় অনুভূতি সৃষ্টি- এইসব ব্যাপারে এই মেলার অবদান ছিল।

উনিশ শতকে গড়ে ওঠা সভাসমিতিগুলির উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করলে স্বার্থ ও লক্ষ্যের নানা বিবর্তন দেখা যায়। গোষ্ঠীস্বার্থ সমষ্টির স্বার্থে উত্তীর্ণ হয়। ক্ষেত্রবিশেষে সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা থাকলেও জাতীয়তাবোধ ও দেশাত্মবোধ বিকশিত হয়। জাতীয় স্বার্থে আন্দোলন গড়ে ওঠে।

Leave a Comment