ইটালির ঐক্য আন্দোলনে ম্যাৎসিনি, ক্যাভুর ও গ্যারিবল্ডির অবদান লেখো।

ইটালির ঐক্য আন্দোলনে ম্যাৎসিনি, ক্যাভুর ও গ্যারিবল্ডির অবদান লেখো
ইটালির ঐক্য আন্দোলনে ম্যাৎসিনি, ক্যাভুর ও গ্যারিবল্ডির অবদান লেখো

ভূমিকা: 

ইটালিতে যে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার জন্ম হয়েছিল, তার অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন জোসেফ ম্যাৎসিনি (1805-72 খ্রিস্টাব্দ)। প্রথম দিকে তিনি কার্বোনারি দলের সদস্য ছিলেন। পরে 1831 খ্রিস্টাব্দে ইটালিবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবাদ বিকাশের উদ্দেশ্যে তিনি ইয়ং ইটালি নামক একটি দল গঠন করেন। তিনি মনে করতেন, ইটালির যুবশক্তিকে জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত করতে পারলেই ইটালি ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবে।

ম্যাৎসিনির আদর্শ : 

ম্যাৎসিনি দেশীয় শক্তির ওপর নির্ভর করে ইটলিকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। ② ইটালির যুবসম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তিনি ইটালির প্রাচীন গৌরব কাহিনি প্রচার ও দেশপ্রেম বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। ③ ঐক্যবদ্ধ ইটালির জন্য তিনি অস্ট্রিয়ার উচ্ছেদ অপরিহার্য বলে মনে করতেন। ④ তিনি প্রজাতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।

ইটালির ঐক্য আন্দোলনে ম্যাৎসিনির অবদান :

① ম্যাৎসিনির কার্যকলাপের ফলে ইটালিবাসীর মনে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বিকশিত হয়।

② ম্যাৎসিনি অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং তার জন্য মানসিক প্রস্তুতিতে সহায়তা করেছিলেন।

③ ইটালির ঐক্য আন্দোলনে তিনি নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন।

④ ঐতিহাসিক গ্রেনভিল তাঁকে ইটালির ঐক্য আন্দোলনের বৌদ্ধিক অগ্রদূত বলে উল্লেখ করেছেন।

⑤ ম্যাৎসিনির ব্যর্থতার মধ্যে দিয়েই ইটালিবাসী তাদের ভবিষ্যৎ পথ খুঁজে পেয়েছিল।

ইটালির ঐক্য আন্দোলনে ক্যাভুরের কার্যকলাপ : 

ক্যাভুরের কার্যকলাপকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করা যায়-

প্রথম ধাপ: পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ক্যাভুর তাঁর রাজ্যে নতুন মুদ্রা সংস্কার, কুটিরশিল্পের উন্নতি, ঋণদান, ব্যাংক, বিমা সংস্থা গড়ে তোলেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও সামরিক সংস্কারের মাধ্যমে তিনি রাজ্যের চেহারা বদলে দেন। রেলপথ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে দেশের প্রাদেশিক সংকীর্ণতা যেমন দূর হয়, তেমনি জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বিকশিত হয়। ঐতিহাসিক থমসন বলেছেন, ক্যাভুরের অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি তাঁর রাজনৈতিক সাফল্যের মূল ভিত্তি ছিল। (Cavour’s economic reforms were the basis of his political success.)

দ্বিতীয় ধাপ: ক্যাভুর তাঁর আদর্শ অনুযায়ী পিডমন্ট-সার্ডিনিয়াকে শক্তিশালী করার পর ওই রাজ্যের নেতৃত্বে ইটালিকে ঐক্যবদ্ধ করার পথে অগ্রসর হন। এই পর্বে তিনি সুযোগ খুঁজতে থাকেন কীভাবে এই নেতৃত্বের সূত্রপাত ঘটানো যায়।

তৃতীয় ধাপ: এই পর্যায়ে তিনি বিদেশি শক্তির সাহায্য লাভে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। ফলস্বরূপ ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও তুরস্কের পক্ষে যোগ দেন। যুদ্ধের শেষে অনুষ্ঠিত প্যারিস সম্মেলনে (1856 খ্রিস্টাব্দ) ক্যাভুর সকলের সামনে ইটালির সমস্যা তুলে ধরেন। ফলস্বরূপ, তিনি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সহানুভূতি লাভ করেন। ক্যাভুরের এটা একটা বড়ো সাফল্য ছিল। এরপর 1858 খ্রিস্টাব্দে তিনি প্লমবিয়ার্স নামক স্থানে ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ানের সঙ্গে প্লমবিয়ার্সের চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই গোপন চুক্তিতে স্থির হয় অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফ্রান্স ইটালিকে সাহায্য করবে এবং বিনিময়ে স্যাভয় ও নিস লাভ করবে।

চতুর্থ ধাপ : এই পর্যায়ে বাস্তবে তিনি তাঁর কাজ শুরু করেন। পরিকল্পনামতো ধাপে ধাপে এগিয়ে তিনি এবার অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু করেন। তিনি এমনভাবে শুল্ক আইন প্রণয়ন করেন যাতে তা অস্ট্রিয়ার স্বার্থবিরোধী হয়। তা ছাড়া তিনি লোম্বার্ডি ও ভেনিসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। এতে উত্তেজিত অস্ট্রিয়া 1859 খ্রিস্টাব্দে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। যুদ্ধে তিনি ফ্রান্সের সাহায্য নিয়ে অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করেন। এরপর ক্যাভুর লোম্বার্ডি ও মিলান দখল করে নেন। কিন্তু যুদ্ধ চলার মাঝপথে ফরাসি সম্রাট অস্ট্রিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিরতির জন্য ভিল্লাফ্রাঙ্কার সন্ধি স্বাক্ষরে সমর্থ হন। ফ্রান্সের সাহায্য ছাড়া যুদ্ধ চালানো অসম্ভব বুঝতে পেরে পিডমন্ট অস্ট্রিয়ার সঙ্গে জুরিখের সন্ধি স্বাক্ষর করে। এই সন্ধি অনুযায়ী পিডমন্ট লোম্বার্ডি লাভ করে। ভেনিস থাকে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে।

এইসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ক্যাভুর প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করেন। কিন্তু ইতোমধ্যে পার্মা, টাস্কানি, মডেনা, রোমানা প্রভৃতি রাজ্যগুলি পিডমন্টের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা ঘোষণা করে। এই সময় ক্যাভুর পুনরায় প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। বাধাদানকারী ফ্রান্সকে তিনি স্যাভয় ও নিস দান করে গণভোটের মাধ্যমে রাজ্যগুলিকে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে নেন। 1860 খ্রিস্টাব্দে গণভোটের মধ্য ইটালির চারটি রাজ্য (আম্ব্রিয়া, মাচেস, নেপলস, সিসিলি) যুক্ত করে নেন। ফলে শুধুমাত্র রোম ও ভেনেশিয়া ছাড়া সমস্ত ইটালি এভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়।

ইটালির ঐক্য আন্দোলনে গ্যারিবল্ডির অবদান: 

ইটালির অন্যতম জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন গ্যারিবল্ডি (1807-1832 খ্রিস্টাব্দ)। গ্যারিবল্ডির কর্মজীবন একজন নাবিক হিসেবে শুরু হয়েছিল। তিনি ইয়ং ইটালি দলের সদস্য ছিলেন। ম্যাৎসিনির নেতৃত্বে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তিনি প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। তখন তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন তিনি প্রজাতন্ত্র রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতেন এবং ‘লালকোর্তা’ নামক একটি বাহিনীও তৈরি করেছিলেন।

গ্যারিবল্ডির কার্যকলাপ : 

1860 খ্রিস্টাব্দে প্রতিক্রিয়াশীল শাসনের বিরুদ্ধে নেপলস ও সিসিলিতে বিদ্রোহ শুরু হয়। এই সময় তিনি বিদ্রোহীদের আহ্বানে সাড়া দেন ও তার লালকোর্তা বাহিনী নিয়ে সেখানে পৌঁছোন। এরপর ওই জায়গা দুটি তিনি তার দখলভুক্ত করার পর পোপের রাজ্য জয়ের পরিকল্পনা করেন। এই অবস্থায় ক্যাভুর চিন্তিত হয়ে পড়েন। কারণ, পোপের রাজ্য আক্রান্ত হলে ক্যাথোলিকরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এই সময়ে ক্যাভুর পোপের রাজ্য বাদে সমগ্র ইটালি জয় করে নেপলস ও সিসিলির আনুগত্য দাবি করেন। গৃহযুদ্ধ এড়ানোর জন্য গ্যারিবল্ডি নেপলস ও সিসিলি রাজ্য দুটি ভিক্টর ইম্যানুয়েলের (পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার রাজা) হাতে তুলে দেন। ইটালি ঐক্যবদ্ধ হয়। ইটালিতে জাতি রাষ্ট্র গঠিত হয়।

গ্যারিবল্ডির নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগে ইটালির ঐক্য আন্দোলন সম্পন্ন হয়েছিল। গ্যারিবল্ডির আদর্শ ও কর্মপন্থা ইটালির ইতিহাসে দিকচিহ্ন স্বরূপ।

Leave a Comment