আমেরিকায় অর্থনৈতিক মহামন্দার কারণ কী? |
ভূমিকা:
বিশ্বের অর্থনৈতিক ইতিহাসে 1929 থেকে 1939 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, এই দশ বছর এক ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা যায়, যা সাধারণত অর্থনৈতিক মন্দা নামে পরিচিত। আমেরিকার এই অর্থনৈতিক মন্দার পশ্চাতে বিভিন্ন কারণ দায়ী ছিল। নীচে সেই কারণগুলি বর্ণিত হল।
অর্থনৈতিক বিপর্যয় :
আমেরিকার অর্থনীতির কতকগুলি মৌলিক ত্রুটি এই মন্দাভাবকে ত্বরান্বিত করেছিল। বিংশ শতাব্দীর কুড়ির দশকে আমেরিকার জনগণের মধ্যে জাতীয় আয়ের কোনো সুষম বণ্টন ছিল না। আমেরিকার জাতীয় আয় ক্রমশ বৃদ্ধি পেলেও তা সমাজের সামান্য কিছু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। উঁচু তলার মানুষের সঙ্গে নীচু তলার মানুষের জীবনযাত্রার ব্যবধান ছিল চোখে পড়ার মতন।
ত্রুটিপূর্ণ অর্থনীতি:
আমেরিকার শিল্প-বাণিজ্য অত্যন্ত উন্নত হওয়া সত্ত্বেও শ্রমজীবী মানুষের মজুরি ছিল অত্যন্ত কম। সাধারণ মানুষের আয় কম থাকার ফলে শিল্পজাত পণ্যদ্রব্য কেনার বিশেষ লোক ছিল না। ফলে আমেরিকায় শিল্পজাত পণ্যদ্রব্যের সরবরাহ প্রচুর থাকলেও, সেইসব জিনিসের চাহিদা কম ছিল এবং প্রচুর পণ্য নষ্ট হত। কারণ আমেরিকার বাজারে চাহিদা এবং জোগানের মধ্যে ভারসাম্য না থাকায় সেখানে ক্রেতার অভাব ছিল।
কিস্তিবন্দি বাজার:
আমেরিকার সাধারণ মানুষের আর্থিক সামর্থ্য না থাকলেও তারা শৌখিন দ্রব্য ক্রয় করে উন্নত জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখত। অন্যদিকে পণ্য বিক্রেতারাও বিভিন্ন উপায়ে পণ্য বিক্রি করতে চাইত। এভাবে আমেরিকায় প্রথম, কিস্তিতে জিনিস বিক্রি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে যেখানে সাধারণ মানুষের আর্থিক সামর্থ্য ছিল কম, সেখানে কিস্তির প্রলোভন ছিল ক্ষতিকারক।
পুঁজিবাদের দুর্বলতা :
পুঁজিপতি অর্থনীতির দেশ আমেরিকার অর্থনীতি নির্ভর করত বৃহৎ পুঁজিপতিদের অংশগ্রহণের ওপর। এখানে ক্ষুদ্র শিল্পপতিদের ভূমিকা ছিল নগণ্য। এর ফলে আমেরিকান অর্থনীতির ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
মন্দার সময় কৃষকের সংকট:
অর্থনৈতিক মন্দার ফলে আমেরিকার কৃষক সম্প্রদায় সর্বাপেক্ষা দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছিল। সমগ্র জনসংখ্যার 1/3 অংশ ছিল কৃষক। কৃষকরা যথেষ্ট উৎপাদন করলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে তাদের অতিরিক্ত পণ্য বিক্রির সুযোগ ছিল না বা বিদেশিদের কাছেও আমেরিকান শস্য ক্রয় করার মতো ডলার ছিল না। কৃষিক্ষেত্রে অবহেলা আমেরিকার অর্থনীতির পক্ষে শুভ ছিল না।
বিশ্ব অর্থনীতির ভারসাম্য বিনষ্ট:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জনিত ব্যয়, ঋণ ইত্যাদি কারণে বিশ্ব অর্থনীতির ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছিল। আমেরিকা নতুন করে সংকটের আশঙ্কায় প্রচুর পরিমাণ সোনা এনে দেশে জমা করেছিল। অথচ স্বাভাবিক ব্যাবসাবাণিজ্য বজায় রাখার জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশে সেই সোনার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমেরিকার শুল্ক নীতির কারণে স্বাভাবিক বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে সেই সোনা ফিরে যায়নি।
শেয়ার বাজার:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অস্বাভাবিক বাণিজ্যিক পরিস্থিতির কারণে বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের শেষের দিকে শেয়ার মূল্য প্রকৃত মূল্যের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
অসম সম্পদ বণ্টন:
আমেরিকার সরকার এবং বাণিজ্যিক মহল উভয়ের লক্ষ্য ছিল উৎপাদন বৃদ্ধি। একদিকে কৃষি উদ্বৃত্ত জমতে থাকে, অন্যদিকে কৃষকদের শিল্পজাত পণ্য ক্রয়ের ক্ষমতা না থাকার ফলে শিল্পোৎপাদনের সুফল অসমভাবে বণ্টিত হয়। এক কথায় অর্থ সঞ্চিত হয় বিত্তশালীদের হাতে।
আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও আমেরিকা:
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক ভারসাম্য ছিল না। 1920 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আমেরিকা এতটাই সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠেছিল যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষের পুনর্গঠনের জন্য প্রচুর টাকা ঋণ দিয়ে সাহায্য করেছিল। ডয়েস পরিকল্পনা অনুসারে 1924 খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা জার্মানিকে তার ক্ষতিপূরণ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রচুর টাকা ঋণ দিয়েছিল। আমেরিকার শুল্ক প্রাচীরের ফলে ইউরোপীয় দেশগুলিতে ব্যাবসাবাণিজ্যে মন্দা দেখা দেয়। ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলির পুনর্গঠনেও অনেক সময় লেগে গিয়েছিল এবং আমেরিকারও ঋণ ফিরে পেতে দেরি হচ্ছিল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার ফলে আমেরিকার অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
সামগ্রিক বিপর্যয়:
উপরোক্ত কারণগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শেয়ার বাজারের দ্রুত পতন। উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে ব্যাংক ঋণের পরিমাণও হ্রাস পায়। শিল্পে মন্দা দেখা দেওয়ার ফলে প্রচুর শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়ে পড়ে। বেকার সংখ্যা অভাবনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। শুধুমাত্র আমেরিকাতেই নয়, আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল দেশগুলিতেও তীব্র আর্থিক সংকট দেখা দেয়। বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষেত্রেও আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়ে।