আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা লেখো

শ্রমিক আন্দোলনের উপর বামপন্থীদের প্রভাব এসময় থেকে আবার বাড়তে থাকে
শ্রমিক আন্দোলনের উপর বামপন্থীদের প্রভাব এসময় থেকে আবার বাড়তে থাকে।

ভূমিকা

গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত দ্বিতীয় সর্বভারতীয় অহিংস গণ আন্দোলন ছিল লবণ সত্যাগ্রহ বা আইন অমান্য আন্দোলন। এই আন্দোলনের দুটি পর্যায় ছিল। প্রথম পর্যায়টি সংগঠিত হয়েছিল ১৯৩০-৩১ খ্রিস্টাব্দে এবং দ্বিতীয়টি ১৯৩২-৩৪ খ্রিস্টাব্দে। এই আন্দোলন বিস্তৃতির দিক থেকে অসহযোগ আন্দোলনকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

পরিস্থিতি

অসহযোগ আন্দোলনের আগে যেমন ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করেছিল তেমনি আইন অমান্য আন্দোলনের আগেও আর্থিক ও রাজনৈতিক সমস্যা ছিল। যেমন- ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের বিশ্ব আর্থিক মহামন্দার ভয়াবহ প্রভাব ভারতেও পড়েছিল। সাইমন কমিশন বর্জন, সর্বদলীয় সম্মেলনের ব্যর্থতা, স্বরাজ গঠনের আদর্শ গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ের জন্য রাজনৈতিক দোলাচল সৃষ্টি হয়।

শ্রমিক ধর্মঘট

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল গান্ধিজি ডান্ডি-র বেলাভূমি থেকে একমুঠো লবণ সংগ্রহ করে ইংরেজ সরকারের লবণ আইন ভঙ্গ করেন। এই ঘটনাটি ছিল প্রতীকী। এরপর দেশব্যাপী আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়।

মহারাষ্ট্র: লবণ সত্যাগ্রহের জন্য সরকার গান্ধিজিকে গ্রেফতার করে। এই সংবাদে মহারাষ্ট্রের শোলাপুরে বস্ত্রশিল্পের শ্রমিকেরা ৭ মে থেকে ধর্মঘট আরম্ভ করে। সাধারণ মানুষ ধর্মঘটি শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ায়। তারা যৌথভাবে পুলিশের থানা, আদালত ভবন, পৌরসভা ভবন এবং মদের দোকানগুলিতে আক্রমণ চালায়। শোলাপুরে কিছুকাল সরকারি প্রশাসন বিলুপ্ত হয়। সেখানে জনতার সমান্তরাল প্রশাসন গড়ে ওঠে। নানা জায়গায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। 

বোম্বাইতেও আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিকেরা অংশগ্রহণ করে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি প্রায় ২০,০০০ শ্রমিক ধর্মঘট করে। এই শ্রমিকদের একটা বড়ো অংশ ছিল গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ের কর্মী। গান্ধিজি লবণ সত্যাগ্রহ শুরু করলে রেলকর্মীরাও আন্দোলনে যোগ দেয়। তারা রেললাইনের উপর লাল পতাকা লাগিয়ে শুয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পুলিশ গুলি চালায়। ব্যাপক দমন পীড়নের বিরুদ্ধে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ৬ জুলাই ‘গান্ধি দিবস’ পালন করে।

বাংলা: গান্ধিজির গ্রেফতারের সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়ে। শ্রমিকশ্রেণি উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বালি পাটকলের শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে। হাওড়া স্টেশনের কুলিরা কাজ বন্ধ করে দেয়। অশান্তির আশঙ্কায় সরকার হাওড়া স্টেশনে সৈন্য মোতায়েন করে। কলকাতার পরিবহণ শ্রমিকেরা আন্দোলনে যোগ দেয়। তারাও ধর্মঘট করে।

অন্যান্য রাজ্য: করাচি বন্দরের শ্রমিকেরাও এই আন্দোলনে যোগ দেয়। মাদ্রাজের শ্রমিকেরা ইউরোপীয় মালিকানাধীন বস্ত্র ও অন্যান্য শিল্পে ধর্মঘট করে এবং কাজ বন্ধ রাখে। বিহারের খনিজ শিল্পশ্রমিকেরা সীমিতভাবে এই আন্দোলনে যোগদান করে।

শ্রমিক আন্দোলনের তীব্রতা

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শ্রমিক আন্দোলনের তীব্রতা কমে আসে। ১৯৩২-৩৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শ্রমিকরা অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ছিল। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা গঠিত হলে শ্রমিকশ্রেণি আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। কেন-না এসময় থেকে কমিউনিস্টরা আবার জাতীয় রাজনীতির মূল স্রোতে ফিরে আসে। শ্রমিক আন্দোলনের উপর বামপন্থীদের প্রভাব এসময় থেকে আবার বাড়তে থাকে।

মূল্যায়ন

আশা করা গিয়েছিল, অসহযোগ আন্দোলনের তুলনায় এই আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিকেরা বেশি সংখ্যায় যোগ দেবে, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। পরিস্থিতি ধর্মঘটের অনুকূল থাকা সত্ত্বেও শ্রমিকশ্রেণি এই আন্দোলনে আগ্রহ দেখায়নি। এর কারণ হিসেবে সুমিত সরকার বলেছেন, গান্ধিজির ১১ দফা দাবিতে ও সাধারণভাবে কংগ্রেসের নীতিতে শ্রমিকশ্রেণির অভিযোগগুলিকে উপেক্ষা করা হয়। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় কমিউনিস্ট নেতারা কারারুদ্ধ থাকায় এই দলের শ্রমিক সংগঠনগুলি আন্দোলনে যোগ দেয়নি। গান্ধি-আরউইন চুক্তি আন্দোলনকে মাঝপথে থামিয়ে দেয়। ফলে গান্ধিজির উপর থেকে শ্রমিকশ্রেণি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।

Leave a Comment